ঢাকা,বুধবার, ১ মে ২০২৪

লোকসানের মুখে ফুলচাষে আগ্রহ হারাচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চাষীরা

দক্ষিণ চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :

বিভিন্ন দিবস বা ঘর সাজাতে জীবন্ত ফুলের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে বাজার কৃত্রিম ফুলের দখলে নেয়ায় গত কয়েক বছর ধরে লোকসানের মুখে পড়ায় ধীরে ধীরে ফুল চাষ ছেড়ে আগের মতোই সবজি আবাদে ঝুঁকছে চরখাগরিয়ার কৃষকরা। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয় সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের চরখাগরিয়া গ্রামে। চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ফুলের চাহিদা পুরণ হয় এখানকার উৎপাদিত নানান জাতের ফুল দিয়ে। চরখাগরিয়া গ্রামের কৃষক মো. শফি। ১২ বছর ধরে ফুল চাষ করে আসছে। প্রতিবছর মৌসুমে ফুল চাষ করে জমির খাজনা, সার, বীজ ও শ্রমিকের মজুরীসহ সব খরচ বাদ দিয়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হতো। গত শীত মৌসুমে ১ একর জমিতে বিভিন্ন কালারের গ্লাডিওলাস, লাল গেঁদা ও বাসন্তি ফুলের আবাদ করেছেন তিনি। প্লাস্টিকের ফুল আমদানি হওয়ায় বাজারে তাজা ফুলের চাহিদা কমে যাওয়ায় ওই সময় ৫০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তার। এবারও একই পরিমাণ জমিতে নানা জাতের ফুল চাষ করে গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠ থেকে উঠা ফুল বিক্রি করে পেয়েছেন ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। জমিতে আরও ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি ফুল বিক্রি হতে পারে। এতে তার লোকসান হবে ৬০ হাজার টাকা। বাজারে প্লাস্টিক ফুলে আগ্রাসনে মাঝে মাঝে গ্লাডিওলাস ফুল বীজ ক্রয় দামে বিক্রি করতে হয় তাদের । জমির খাজনা ও অন্যান্য খরচ মিলে বীজ রোপনের ৩ মাসের মাথায় প্রতি গ্লাডিওলাস ফুল উৎপাদনে যেতে ৪ টাকার কাছাকাছি খরচ পড়েছে তার। লোকসানের আশঙ্কায় এ মৌসুমে ফুল চাষ কমিয়ে ফেলেছেন অনেক চাষি এমনটায় জানালেন কৃষক শফি। গত বছর শীত মৌসুমে ২০ লাখ টাকা খরচ করে ৫শ ৬০ শতক জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ করেছেন চরখাগরিয়া গ্রামের কষক মো. আব্দুল গফুর। ওই মৌসুমে তাকে লোকসান দিতে হয়েছে ৫ লাখ টাকারও বেশি। তাই এবার অর্ধেকেরই বেশি ফুলের আবাদ কমিয়ে ২শ ৪০ শতক জমিতে ফুল চাষ করেছেন তিনি। এর মধ্যে ১শ ২০ শতক জমিতে গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করেছেন গফুর। যাদের হাত ধরেই প্রথম ফুল চাষের আবাদ শুরু হয়েছে এ গ্রামে। তারাই ফুল চাষ থেকে সরে সবজির আবাদের দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ভারত থেকে বীজ এনে গ্লাডিওলাস ফুলের আবাদ শুরু হয়েছে তাদের (গফুরের) পরিবারে। গ্রামে তাদের জমিতে উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য শহরের চারাগী মোড়ে গড়ে উঠেছে ২টি দোকান। এসব দোকানে খুচরা ও পাইকারী বিক্রি করা হয় নানা জাতের তাজা ফুল। কেন ফুলের বাজারে এমন ধস এর ব্যাখ্যা দিয়ে গফুর বলেন, দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা প্লাস্টিকের ফুল আমদানির মাধ্যমে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে জীবন্ত ফুলের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ কৃত্রিম ফুল এক বার কেনা হলে যেকোনো অনুষ্ঠানে এটি ব্যবহার করা যাচ্ছে। এতে তাজা ফুলের সুঘ্রাণ না ফেলেও তাদের টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ ঝুঁকির আশঙ্কায় তাজা ফুল উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা। চাষিরা ফুলের বিকল্পে অন্য ফসল আবাদের দিকে চলে যাচ্ছে বললেন আব্দুল গফুর।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি চরখাগরিয়া সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গত বছর যেখানে পুরো মাঠ ভরা ফুল চাষ দেখেছিলাম, সেখানে এবার ফুলের চেয়ে সবজি চাষ বেশি হয়েছে। আগের তুলনায় অনেকটায় কম ফুল চাষ হয়েছে। গেঁদা গাছ থেকে মাটিতে পড়ে সাজিয়ে গেছে। গ্লাডিওলাসের কয়েকটি বাগান চোখে পড়ে। ফুল ফোটে আছে। বাজারে চাহিদা না থাকায় বাগানের পাশে আলুর আবাদকৃত জমিতে পরিচর্যা করছেন চাষি মো. রফিক।

তিনি বলেন, এখানকার বাসিন্দারা কয়েক যুগ ধরে ফুলের আবাদ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। প্লাস্টিকের ফুল বাজার দখলে নেওয়ায় গ্রামের ফুল চাষিরা মুনাফা করতে পারছে না। এই ফুলের রাজ্যে যাদের বেশি ফুল চাষ হয়, তারাই এখন ফুলের চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। প্রতিবছর ধীরে ধীরে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছে কৃষকরা। প্লাস্টিকের ফুল আমদানি বন্ধ করা না গেলে দেশের এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া প্রথম বারের মতো ৩০ শতক জমিতে গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করে ৭০ হাজার টাকা লোকসান দিলেন চরখাগরিয়ার বাসিন্দা মো. হারুনুর রশিদ। তিনি বলেন, লাভজনক মনে করে ১লক্ষ ২৮ হাজার টাকা খরচ করে এই প্রথম ফুল চাষ করলাম। প্লাস্টিকের ফুলের কারণে তাজা ফুলের অনেকটায় দাম কমে যাওয়ায় ৭০ হাজার টাকায় লোকসান হলো।

সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শোয়েব মাহমুদ বলেন, খাগরিয়াতে ১২ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে। তৎমধ্যে গ্লাডিওলাস চাষ হয়েছে ৫ হেক্টর। প্লাস্টিকের ফুল বাজার দখলে নেয়ায় তাজা ফুলের চাহিদা কমেছে। ফলে চাষিরা ফুল চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে। আমরা কৃষি অফিস থেকে ফুল চাষিদের সার্বক্ষনিক উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

পাঠকের মতামত: