ঢাকা,বুধবার, ১ মে ২০২৪

নাটের গুরু সহকারি প্রকৌশলী

অনিয়ম দুর্নীতির আখড়া চকরিয়া বিদ্যুৎ অফিস

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::  সিন্ডিকেট অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে চকরিয়া বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ। এসব অনিয়ম দুর্নীতির শীর্ষে এ বিভাগের সহকারি প্রকৌশলী ডিএম সাইদুজ্জামান। তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় শতভাগ বিদ্যুতায়নে খুটি স্থাপন ও সংযোগ লাইন চালু এবং মিটার বিতরণে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় ছাড়াও হয়রাণির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় দুইমাস আগে চকরিয়া উপজেলা এবং পৌরসভার এলাকার একাধিক গ্রাহক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিদ্যুৎ বিভাগ চট্টগ্রাম দক্ষিন অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী (বিতরণ) কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।

ভুক্তভোগী গ্রাহকরা অভিযোগ তুলেছেন, ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর উপসহকারি প্রকৌশলী ডিএম সাইদুজ্জামানের তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে লিখিতভাবে অভিযোগ করা হলেও অদৃশ্য কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোন ধরণের প্রদক্ষেপ নেয়নি। এ অবস্থার কারণে অভিযুক্ত সহকারি প্রকৌশলী ডিএম সাইদুজ্জামান এখনও বহাল তবিয়তে থেকে বিদ্যুৎ সেবাখাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে চকরিয়া বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী মারা যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পেয়ে গত ডিসেম্বর ও চলতি জানুয়ারী মাসে তিনি লাগামহীনভাবে অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।

গ্রাহকদের অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, চকরিয়া বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে আজিজনগর গজালিয়া এলাকায় গেলবছর প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প শতভাগ বিদ্যুতায়ন কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হবার সুযোগে লাগামহীন অনিয়মে জড়িয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সবধরণের সরকারি বরাদ্দ থাকলেও সহকারি প্রকৌশলী ডিএম সাইদুজ্জামান তাঁর অনুগত লোকজনের মাধ্যমে আজিজনগর ও গজালিয়াসহ আশপাশ এলাকার গ্রাহকদের কাছ থেকে শতভাগ বিদ্যুতায়নে খুটি স্থাপন ও সংযোগ লাইন চালু করতে টাকা আদায় করেছে। কথা মতো টাকা না দিলে গ্রাহকদের নানাভাবে হয়রাণি করার অভিযোগও রয়েছে।

আজিজনগর গজালিয়া এলাকার বেশিরভাগ গ্রাহকের দাবি, উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরেজমিনে তদন্ত করলে সহকারি প্রকৌশলী ডিএম সাইদুজ্জামান ও তাঁর অনুগত লোকজনের অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়টি সর্ম্পকে ধারাবাহিক তথ্য পাবে। একইধরণের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের পুলেরছড়াস্থ ফরেস্ট অফিস পাড়ার নতুন বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংযোগ লাইন, খুটি স্থাপন ও মিটার দেয়ার ক্ষেত্রে। সরকারি হিসেবে প্রতিটি মিটার সংযোগ ফ্রি ১৩৯১ টাকা এবং বাহির থেকে একটি মিটার কিনতে ১৩০০ টাকাসহ মোট ২৬৯১ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও ফরেস্ট অফিসপাড়ার বেশিরভাগ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। এছাড়াও সম্প্রতি সময়ে মানিকপুরের উত্তরপাড়া এলাকায় দুই লাখ ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি মোবাইল টাওয়ারে সংযোগ লাইন, খুটি স্থাপন করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে সহকারি প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে।

এদিকে চকরিয়া পৌরসভা এলাকা এবং পিডি নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন এলাকার টমটম গ্যারেজ মালিকরাও হয়রাণির অভিযোগ তুলেছেন সহকারি প্রকৌশলী সাইদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। তাদের দাবি, পিডিবির অধীনে ৮০ থেকে ৯০টি টমটম গ্যারেজ আছে। সবকটি গ্যারেজকে ম্প্রতি সময়ে আগের ডিজিটাল মিটার বদল করে প্রিপেইড মিটার বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অন্তত ৪০টি গ্যারেজে প্রিপেইড মিটার বসানো হয়েছে।

টমটম গ্যারেজ মালিকদের অভিযোগ, পুরানো ডিজিটাল মিটারের পরিবর্তে প্রিপেইড মিটার বসাতে বিদ্যুৎ অফিসে একটি আবেদন ফরম পুরণ করতে হয়। সঙ্গে সরকারি ফ্রি হিসেবে তিনশত পরিশোধ করার নিয়ম থাকলেও সহকারি প্রকৌশলী সাইদুজ্জামানের সিন্ডিকেট আবেদনের সঙ্গে এক হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার লোড বৃদ্দিতে কোন ধরণের সরকারি ফ্রি না থাকলেও প্রতি ওয়ার্টে এক হাজার টাকা করে প্রতিটি টমটম গ্যারেজে বসানো মিটার থেকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং ক্ষেত্র-বিশেষে ২৫-৩০ হাজার টাকা আদায় করছেন। কেউ দাবিকৃত টাকা না দিলে প্রিপেইড মিটার বসানোর পরও লোড দেওয়া হচ্ছে। এভাবে এখন প্রতিদিন টমটম গ্যারেজ মালিকদেরকে হয়রাণি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।

অভিযোগ উঠেছে, সহকারি প্রকৌশলী ডিএম সাইদুজ্জামান ইতোপুর্বে চকরিয়া অফিসে তিনবছর চাকুরী করলেও দুর্নীতির অভিযোগে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে কুতুবদিয়া বদলি করে। পরে সেখান থেকে অন্যত্র চলে গিয়ে ফের দুইবছর আগে আবারও টাকার বিনিময়ে চকরিয়া উপজেলায় পোস্টিং নেন তিনি।

মুলত তিনি যোগদানের পর থেকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন চকরিয়া বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগকে। কিছুদিন আগে আবাসিক প্রকৌশলী পদে গীতি বসু বড়ুয়া নামের একজন কর্মকর্তা যোগদান করলেও এখনো দাপটের সঙ্গে অফিসে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন সাইদুজ্জামান। তিনি চকরিয়া বিদ্যুত অফিসে নতুন মিটার সংযোগের ক্ষেত্রে নতুন প্রথা চালু করেছেন। কেউ নতুন মিটার নিতে গেলে তাকে অফিসের সিন্ডিকেট চক্রের চালু করা বিশেষ ফান্ডে ১২শত টাকা জমা দেয়ার জন্য বাধ্য করছেন। কোন গ্রাহক অফিসের বিশেষ ফান্ডে ওই টাকা জমা না দিলে তাকে সহজে মিটার সংযোগ দেয়া হচ্ছেনা, উল্টো ওই গ্রাহককে হয়রাণির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক গ্রাহক। তাদের মধ্যে অন্যতম চকরিয়া পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হাকিম দুলাল।

তাঁর ম্যানেজারের দাবি, কিছু দিন আগে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হাকিম দুলালের নামে একটি আবাসিক মিটার নিতে আবেদন করি। ওইসময় অফিসের লোকজন মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। পরে অন্য একজনের মাধ্যমে আবেদনটি জমা দেয়া হলেও অফিসের কর্মকর্তা আবদুল গনি বিশেষ ফান্ডের ১২শত টাকা দাবি করেন। পরে গ্রাহক আনোয়ারুল হাকিম দুলাল বিষয়টি আবাসিক প্রকৌশলীকে জানালে কোন ধরণের লেনদেন ছাড়াই মিটারটি সংযোগ লাইন চালু করে দেন।

অভিযোগ উঠেছে, চকরিয়া বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড, উপজেলার ফাসিয়াখালী, চিরিঙ্গা, পুর্ববড় ভেওলা, কাকারা ও সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন এবং আজিজনগর এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন চালু রয়েছে। এসব এলাকা থেকে মাসে কমপক্ষে দুই শতাধিক গ্রাহক নতুন মিটার নিতে আবেদন করে থাকেন। প্রতিটি মিটার থেকে অফিসের সিন্ডিকেট চক্রের তৈরী করা বিশেষ ফান্ডে ১২শত টাকা করে মাসে দুইশতাধিক মিটারখাতে অন্তত দুই লাখ ৪০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা জমা পড়ে। আর এসব টাকা মাস শেষে অফিসের সংশ্লিষ্টরা প্রকারভেদে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা।

অভিযোগ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে চকরিয়া বিদ্যুৎ বিভাগের উপসহকারি প্রকৌশলী ডিএম সাদিজ্জামান কোন ধরণের মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছেন, উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখবেন।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগ চট্টগ্রাম দক্ষিন অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী (বিতরণ) মো.শামসুল আলম বলেন, উপ-সহকারি প্রকৌশলী সাদিউজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি তদন্তের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়নে খুটি স্থাপন ও সংযোগ লাইন চালু করণ কাজটি সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে তদারকি করা হয়েছে। সেখানে সাদিউজ্জমানের সম্পৃক্ততা নেই। তবে অন্য অভিযোগ গুলো তদন্তে প্রমাণিত হলে অবশ্যই বিহীত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অপরদিকে কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের গনী বলেন, উপসহকারির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি তদন্তধীন আছে। আমি ইতোমধ্যে দুইদফা সংশ্লিষ্ট এলাকা ভিজিট করেছি। অভিযোগকারী এবং এলাকবাসির বক্তব্য নিয়েছি।

তিনি বলেন, তদন্তে বেশিরভাগ অভিযোগের সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে ঘটনার পেছনে চকরিয়া বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু বেতনহীন সুবিধাভোগী কর্মচারী এবং তাদের সিন্ডিকেট কলকাড়ি নারছে বলে মনে হচ্ছে।

 

 

পাঠকের মতামত: