অনলাইন ডেস্ক :: ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্তে্বর মতো অনেকটা জ্যামিতিক হারেই দেশে বাড়ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা। ৪ এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৯ জন। ৫ এপ্রিল তা দ্বিগুণ, বেড়ে হয়েছে ১৮ জনে। গতকাল সোমবার এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ জনে। আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। গতকাল তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দেশে একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত দেশের ১৫ জেলায় এই ভাইরাস তার সংক্রমণ বিস্তার করেছে। ঢাকায় সংক্রমণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। সরকার ঘোষিত সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের বিষয়টিও ঢিলেঢালা। যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলছেন, আগামী ৩০ দিন বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী করোনা শনাক্ত এলাকা সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি ঠেকাতে এখনই ‘সারাদেশ লকডাউন’ করা জরুরি।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে গতকাল সোমাবার এক বৈঠকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের (নিমস) পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বর্তমান পরিস্থিতে তার উদ্বেগ জানিয়ে এখনই দেশে ‘শক্ত অবস্থান’ নেয়ার অনুরোধ করেন। বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, দেশে সামনে কঠিন সময় আসছে। এখনই পুরো দেশে লকডাউন করা জরুরি। এখনই পুরো দেশ লকডাউন না করা হলে এই ভাইরাস আগামী ১০ দিনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
করোনা ভাইরাস নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদও। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণ একস্থানে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। তাই ব্যক্তি সচেতনতা দরকার। ইতোমধ্যে দেশের ১৫টি জেলায় কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, জামালপুরে বেশি সংখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারি ঠেকাতে এখনই পাড়া-মহল্লা-গ্রাম-গঞ্জে সক্রিয় গণসার্ভেলেন্স শুরুর পরামর্শ রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোস্তাক হোসেনের। তিনি বলেন, যেসব স্থানে গুচ্ছ আকারে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ছে সেখানে গণসার্ভেলেন্স শুরু করতে হবে। গুচ্ছ হচ্ছে একটি এলাকাতে এক ব্যক্তির দেহে রোগ সংক্রমণের পর সেখান থেকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া। পাড়া-মহল্লা-গ্রাম-গঞ্জে কোভিড-১৯ রোগের উৎস খুঁজে বের করে ওই ব্যক্তিকে আলাদা করা, পরীক্ষা করা, চিকিৎসা করা, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার কাজে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে মহামারিকে ঠেকিয়ে দেয়া যায়। মানুষকে সক্রিয় করেই সেটা সম্ভব।
এদিকে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আইইডিসিআরের বাইরেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন ল্যাবে শুরু হয়েছে নমুনা পরীক্ষা। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল নিজেরাই নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করছে। পরীক্ষার ফলাফল আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। বাইরের ল্যাবে করোনা পজিটিভ হওয়া নমুনা নিজস্ব ল্যাবে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সিদ্ধান্তের কথা রবিবারই জানিয়েছিলেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢালাওভাবে সব ল্যাবের পরীক্ষা যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। মান যাচাইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু নমুনা পুনঃপরীক্ষা করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট ল্যাব কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছেন এমনটি হলে মন্দ হয় না।
বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, মান নিয়ন্ত্রণের জন্য নমুনা আবারো পরীক্ষা করা যেতেই পারে। প্রাথমিকভাবে যখন কোনো ল্যাব কাজ শুরু করে, সেক্ষেত্রে এটি করে নেয়া ভালো। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তে র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এই টেস্টের মাধ্যমে তিন মিনিটের মধ্যে সম্ভাব্য রোগ নির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে। আমরা কম খরচে এটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে পারি। কেউ বলবেন, এতে ভুল রিপোর্টও আসতে পারে। তবু আমি এর সুপারিশ করব। কারণ, বসে থাকার চেয়ে আমাদের যা সামর্থ্য তা নিয়েই কাজ করে যাওয়া উচিত। এই পরীক্ষা থেকে একটা ধারণা তো পাওয়া যাবে। আর যার অ্যান্টিবডি পজিটিভ পাওয়া যাবে, তাকে পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সেই সময় পর্যন্ত তাকে আইসোলেট করে স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে রাখা যায়। বা ওই ব্যক্তি নিজে থেকেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। সুতরাং সরকার এটা একটা কৌশল হিসেবে নিতে পারে। শুধু পিসিআর দিয়েই উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষা করব, এই ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অসহায়ত্ব : গতকাল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে দেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন কমিটির চেয়ারম্যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বৈঠকে অংশ নেয়া এক চিকিৎসক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান বৈঠকে মন্ত্রী বলেন, ওই কমিটিতে কখন কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে সে বিষয়গুলো আমার জানা নেই। কখন গার্মেন্টস কারখানা খোলা হবে, কখন মসজিদে নামাজ হবে, কীভাবে হবে, কখন রাস্তা খুলে দেয়া হবে কিংবা বন্ধ করে দেয়া হবে- এ বিষয়ে আমরা জানি না। স্বাস্থ্য বিষয় বাদে কোনো বিষয়েই আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয় না। কমিটির প্রধান হিসেবে আমি সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু তাদের প্রশ্নের সদুত্তর আমি দিতে পারি না।
সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু : গতকাল দুপুরে করোনা ভাইরাসসংক্রান্ত অনলাইন লাইভ ব্রিফিংয়ে যুক্ত হয়ে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫ জন। আর মৃত্যু হয়েছে আরো তিনজনের। এ নিয়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এখন ১২৩ জন, মৃতের সংখ্যা ১২ জন। মোট আক্রান্তদের ৬৪ জন ঢাকা শহরের। ২৩ জন নারায়ণগঞ্জের। এরপরের বেশি আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে মাদারীপুর এলাকায়। আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৩৫ জনের মধ্যে পুরুষ ৩০ জন। ৫ জন নারী। বয়সভিত্তিক তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, নতুন আক্রান্তদের ১১ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী আছেন ৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তদের ১২ জনই নারায়ণগঞ্জের। মৃত তিনজনের বিস্তারিত তথ্য প্রসঙ্গে সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এদের একজন একসপ্তাহ ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অন্য দুজন নারায়ণগঞ্জের। তারা হাসপাতালে আসার পরপরই মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জকে ইতোমধ্যে ‘হটস্পট’ ঘোষণা করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পরপরই কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং শুরু করি। নতুন আক্রান্ত ৩৫ জনের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং চলছে। কম দূরত্বের মধ্যে একাধিক রোগী থাকলে তখনই ক্লাস্টার ধরে নিয়ে কাজ করে থাকি। বাকি ৮৮ জনের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৬১০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। যারা নমুনা সংগ্রহ করতে যান তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনই এতে বাধা দিচ্ছে।
পাঠকের মতামত: