ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

ফদনার ডেইলে আগুনে নিঃস্ব তছলিমা, বৃদ্ধা রোকেয়া বেগমের আহাজারি

ডিডডশাহজাহান চৌধুরী শাহীন,কক্সবাজার ॥

‘আমার সব শেষ হইয়্যা গেছে, আমি এক্কেবারে ফতুর হইয়্যা গেছি। ভিক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই! ও আল্লাহ তুমি আমার ওপর এমন গজব দিলা কেন? আমি নিঃস্ব হইয়্যা গেলাম।’

কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড ফদনার ডেইল এলাকায় অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া নিজ হাতে গড়া ঘরের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এভাবেই আহাজারি করছিলেন তছলিমা আকতার।

পাশে দাঁড়িয়ে মাথাগুজার একমাত্র মাধ্যমটির ধ্বংবাশেষ দেখে তার স্বামীও বুক চাপড়ে কেঁদেই যাচ্ছিলেন।

শুধু গৃহবধু তছলিমা নয়, ১৩টি বসত ঘর, ২টি কলোনী পুড়ে যাওয়া ফদনার ডেইল জুড়ে ১৮ জানুয়ারী থেকে চলে আসছে আহাজারি ও আর্তনাদ। ঘরের সব মালামাল পুড়ে ছাই, সবার মাথা গোঁজার ঠাঁই পুড়ে ভস্ম।

১৮ জানুয়ারী ২টা ২০মিনিটের দিকে ফদনার ডেইল এলাকায় আগুন লাগে। রান্না ঘরের চুলো থেকে আগুনের সূত্রপাত্র হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজন কাজ করে।

অগ্নিকান্ডের পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আবদুর রহমান, পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরীসহ প্রশাসনের আরো কয়েকজন কর্মকর্তা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ত্রাণ ও পূর্ণবাস শাখা থেকে কক্সবাজার পৌর সভার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২০ কেজি করে চাল ও নিহত মহিলার পরিবারকে ২০ হাজার টাকা নগদ অনুদান দেয়া হয়। ১নং ওয়ার্ডের পৌর কাউন্সিলর এসআইএম আক্তার কামালের তত্ত্বাবধানে ওই অসহায় পরিবারগুলোর মধ্যে ৩৭টি কম্বল বিতরণ করা হয়। পৌর কাউন্সিলর আকতার কামালের তত্ত্বাবধানে ওখানে রান্না করে ২ বেলা খাবার বিতরণ করা হয়।

২৪ জানুয়ারী বিকালে মহিলা কাউন্সিলর হুমায়রা বেগমের তত্ত্বাবধানে ৩৭টি পরিবারের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। কম্বল বিতরণ কালে কথা হয় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সাথে। এদের মধ্যে একজন তছলিমা।

স্বামী সন্তান নিয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে ফদনার ডেইলে বসবাস তছলিমা আকতারের। স্বামী টমটম চালক। ২ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে এখানে ছিলো।

তিল-তিল করে প্রায় ৩০ হাজার টাকা জমান। তাও আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেলো। সেই সাথে পুড়ে গেছে স্কুল পড়–য়া ছেলে ইয়াছিন আরাফাত (৮ম শ্রেণীর ছাত্র) ও এহেছান উদ্দিন (৯) এর বই, খাতা, স্কুল ব্যাগ জুতা সহ সব কিছু।

তছলিমা আকতার বলেন,‘ঘর তালা বদ্ধ করে সকালে শহরে গিয়েছিলাম। বাড়ীতে কেউ ছিলনা। দুপুরের পরেই বাড়ীতে এসে দেখি আগুনে সব শেষ করে দিয়েছে। আমি খবর পেয়ে এসে দেখি দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে। বাড়ী থেকে কিছুই বের করা যায়নি।

তিনি বলেন, কয়কদিন থেকে টাকা জমাচ্ছিলাম নতুন করে টমটম ক্রয় করবো বলে, সে টাকাও পুড়ে গেছে।’

তছলিমার মতো আগুনে নিঃস্ব হয় আরো ৩৬ পরিবার। নিজের পুড়ে যাওয়া ঘরের আসবাবপত্র দেখাতে গিয়ে বলেন, ‘সব শেষ, কিছু জমানো টাকা ছিলো তাও পুইড়া গেলো, এখন কী নিয়ে বাঁচমো। ছেলে মেয়েদের নিয়ে রাস্তায় থাকন ছাড়া কোনো উপায় নাই।’

আরেক জন রোকেয়া বেগম (৭০)। তিন সন্তানের এই জননী একটি মাত্র থাকার ঘর। এই ঘরের মালিক এই নারী রোকেয়া। স্বামী, সন্তান, পুত্র বধু আর নাতী নাতনীদেও নিয়ে থাকতেন এই ঘরে।

বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া বা খেপুপাড়া উপজেলা বাসিন্দা ছিলেন রোকেয়া বেগম। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার রামনাবাদ নদীর ভাঙ্গনে সর্বস্বহারা রোকেয়া পরিবার সেই ২০ বছর আগেই চলে আসেন কক্সবাজার শহরে। গত ১৫ বছর ধরেই বসবাস ফদনার ডেইল এলাকায়। চোখের সামনেই সবকিছু পুঁেড় যাচেছ, তাই আগুনের ভয়াবহতা ঘটনাস্থলেই মারা যান তার পুত্রবধু হোসনে আরা (৪৫)।

তিনি মোঃ ছালেকের স্ত্রী।

“আমরা আর কম্বল চাইনে, আমরা চাই মাথা গুজার ঠাই। সর্বনাশা আগুন আমাগের সব কিছুই শেষ করে গেছে। এমন কেও নেই যে আমাদের দেখপে।” কথাগুলো বলেন কম্বল নিতে আসা রোকেয়া বেগম (৭০)। একই কথা বলেন তছলিমা আকতার (৩৬) ও হাসিনা (৩৮)।

তছলিমা, রোকেয়া, দিলোয়ারা, ময়না, হাসিনা, সুমি, মিনু আরা ও জাহানারা বেগমের মতো আগুনে নিজেদের শেষ সম্বল হারিয়ে এখন নিঃস্ব, দিশেহারা।

তাদের চোখে-মুখে এখন শুধুই সাহায্যের আকুতি। তারা চান অন্তত ঘরের চাউনি দেওয়ার মতো টিন। অন্তত শীতের রাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবো।

কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রাথমিক অনুদান দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা আমরা জেলা প্রশাসকের নিকট পাঠিয়েছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সকলেই মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকলকে আশ্বস্থ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পাঠকের মতামত: