ঢাকা,শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘জনগণের টাকায়’ নিজের ভাস্কর্য গড়ছেন এমপি

0014274_kalerkantho-16-8-31অনলাইন ডেস্ক :::

বরিশাল জেলা পরিষদ কোষাগারের টাকা ব্যয় করে নিজের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন বরিশাল-৬ আসনের সংসদ সদস্য রতনা আমিন। অভিযোগ রয়েছে, জেলা পরিষদের উন্নয়ন প্রকল্পের বিধি ভেঙে সংসদীয় প্যাডে ডিও লেটার দিয়ে নিজের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এরই মধ্যে ভাস্কর্য নির্মাণে দরপত্র আহ্বান  করেছে জেলা পরিষদ। নির্বাচন করা হয়েছে ঠিকাদার। কাজ শুরুর জন্য দেওয়া হয়েছে আদেশ। বরিশাল বাকেরগঞ্জে সংসদ সদস্য রতনা আমিনের নামে একটি মহিলা কলেজ রয়েছে। সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে এই ভাস্কর্য। রতনা আমিনের নামে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটি উন্নয়নে আগে থেকে যে বরাদ্দ ছিল এর বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে ভাস্কর্য নির্মাণে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খাজনাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকা জেলা পরিষদের কোষাগারে জমা হয়। সেই টাকা জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয়। এ জন্য জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা প্রকল্পের চাহিদাপত্র (ডিও) দেন। এই টাকা দিয়ে সাধারণত রাস্তা-বাজার সংস্কার, গভীর নলকূপ স্থাপন, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সংসদ সদস্য রতনা আমিন ‘জনগণের টাকায়’ নিজের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রতনা আমিন মহিলা কলেজের শিক্ষকরা জানান, কলেজ ক্যাম্পাসে ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঠিকাদার এসে দেখে গেছেন। তবে ঠিকাদার শিক্ষকদের সঙ্গে কখনোই আলোচনা করেন না। আলোচনা হয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে। তাই ভাস্কর্য আর রাস্তা সংস্কারে কত টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে সেটিও তাঁরা জানেন না। তবে আয়োজন দেখে ধারণা করছেন ভাস্কর্যের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় হবে। আর রাস্তা সংস্কার বলতে খানাখন্দে মাটি ফেলা ছাড়া তেমন কোনো আয়োজন আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

রতনা আমিন বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি তিনি। বাকেরগঞ্জে তাঁর নামে নির্মিত ‘রতনা আমিন মহিলা কলেজ’ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি তিনি। কলেজ লাগোয়া সংসদ সদস্যের বাগানবাড়ি। সেই বাড়ির পাশেই তাঁর নামে রয়েছে ‘রতনা আমিন সমিতি’। সমিতির অধিকাংশ সদস্যই বাগানবাড়ির কর্মচারী বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছে।

বরিশাল জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মো. লোকমান আলী। তিনি সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। লোকমান আলী জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষ ভাগে নিজস্ব আর এডিপির অর্থের মাধ্যমে ১৪টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। চলতি বছরের ৮ মে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি নম্বর-৫-এর মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান করা হয়। দরপত্রে বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি প্রকল্প ছিল, যার প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় অর্ধকোটি টাকা ধরা হয়েছিল। ওই প্রকল্পগুলোর মধ্যে রতনা আমিন মহিলা কলেজের রাস্তা সংস্কার, ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতার ভাস্কর্য নির্মাণ এবং রতনা আমিন সমিতির কালভার্ট, ফার্নিচার ও রাস্তা সংস্কার ছিল। প্রকল্পগুলো গুচ্ছ আকারে থাকায় পৃথক করে বরাদ্দের বিষয়টি দরপত্রে উল্লেখ নেই।

প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে এই সহকারী প্রকৌশলী আরো বলেন, সাধারণত সংসদ সদস্যরাই প্রকল্প তাঁদের প্যাডে প্রশাসকের কাছে পাঠান। সেখান থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের বিপরীতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। অনেক সময় সংসদ সদস্যরা বেশি প্রকল্প দিয়ে মুঠোফোনে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বিষয়টি অবহিত করেন। সংসদ সদস্য রতনা আমিন তাঁর সংসদীয় প্যাডে আধাসরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়ে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজের প্রতিষ্ঠাতার ভাস্কর্য নির্মাণের প্রকল্প দিয়েছিলেন।

এ ব্যাপারে জানতে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সংসদ সদস্য রতনা আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে নয়ন হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদ সদস্য ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এখনো কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। অধাসরকারি পত্রের (ডিও) মাধ্যমে বেশ কয়েকটি প্রকল্প তিনি জেলা পরিষদে দিয়েছিলেন। তাতে রতনা আমিন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য পাঠানো প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথে।

সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নয়ন আরো বলেন, ‘সাংসদের বাবা অসুস্থ তাই তিনি ব্যস্ত আছেন।’

এ ব্যাপারে জেলা পরিষদের প্রশাসক খান আলতাফ হোসেন ভুলু মুঠোফোনে বলেন, ‘জনগণের টাকায় কোনো ব্যক্তির ভাস্কর্য হতে পারে না। জেলা পরিষদের টাকায় এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ঘটনা এই প্রথম। যেহেতু আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই প্রকল্পটির দরপত্র থেকে শুরু করে কার্যাদেশ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে; তবু জনগণের টাকা যাতে জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয় সে জন্য প্রকল্পটি বাতিলের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

প্রতিষ্ঠাতার নাম বাদ নিয়ে নিজের নামে কলেজ : ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসন থেকে অধ্যক্ষ ইউনুস খান নির্বাচিত হন। ওই সময় তিনি বিএনপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের পাশে বাকেরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের কাছে ১৯৯৩ সালে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজের নাম দেন ‘ইউনুস খান মহিলা কলেজ’। পরে তাঁর মৃত্যু হলে কলেজের জমি নিয়ে মামলা হয়। পরে কলেজটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০১ সালের শুরুতেই তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কলেজটি চালু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মহিলা কলেজ নামে কলেজটি ২০১০ সালে এমপিওভুক্ত হয়। কলেজে দুই শর বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কলেজের একাধিক শিক্ষক বলেন, ওই সময় রতনা আমিন ও তাঁর স্বামী রুহুল আমিন দুজনই সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁদের অধাসরকারি পত্রে কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে কলেজের নাম পরিবর্তন করে রতনা আমিন নামে নামকরণ করেন।

সরকারি বিধি অনুযায়ী, নাম পরিবর্তনের জন্য সংসদ সদস্য কয়েক দিনের জন্য কলেজ ফান্ডে ১৪ লাখ টাকা দান করেন। পরে সেই টাকা কলেজের উন্নয়নের জন্য উত্তোলন করেন। তখন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সংসদ সদস্য টাকা শুধু কলেজের ব্যাংক হিসাবে রেখে আবার উত্তোলন করে নিয়েছেন। বিষয়টি সব শিক্ষকই অবগত রয়েছেন।

পাঠকের মতামত: