ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

পরিবেশ জীববৈচিত্র্য ঝুঁকিতে, ২৪ সুপারিশ কেউ শোনেনি, বিপন্ন সেন্ট মার্টিনস

অনলাইন ডেস্ক ::

চারপাশেই নীল জলরাশি। মাঝখানে পাঁচ বর্গকিলোমিটারের সেন্ট মার্টিনস। দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ। স্বচ্ছ পানিতে বাহারি রঙের প্রবাল আর রঙিন মাছ দ্বীপের সৌন্দর্যে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। সামুদ্রিক কাছিমের প্রজননকেন্দ্রও এই দ্বীপে। সারা বছর লাখো পর্যটকের মনের খোরাক যে দ্বীপ, সে নিজে কেমন আছে? সম্প্রতি কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভালো নেই অপার সম্ভাবনার সেন্ট মার্টিনস। মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে একে বিপন্ন করে তুলেছে কিছু মহল। কংক্রিটের থাবা। শব্দদূষণ। অবাধে প্রবাল লুট। এককথায় বাণিজ্যিক থাবায় কুঁকড়ে যাচ্ছে মনোলোভা এই দ্বীপ। সেন্ট মার্টিনস রক্ষায় ২০০৯ সালেই সরকারকে ২৪ সুপারিশ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর, যার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। আর এই সুযোগেই অব্যবস্থাপনা এখন নৈরাজ্য পর্যায়ে গড়িয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।

সুপারিশে বলা হয়েছিল, দ্বীপে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করতে হবে। পর্যটককে দিনে দিনে ফিরে আসতে হবে, সে ক্ষেত্রে আবাসন সুবিধা টেকনাফে করা যেতে পারে। বাস্তবে দেখা গেল, পর্যটকদের রাতে থাকার জন্য সেখানে দেড় শতাধিক হোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। সুপারিশ ছিল এরই মধ্যে দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আবাসন কাঠামোগুলো উচ্ছেদ করার; আট বছরেও এর বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে হোটেল গড়ার নামে দ্বীপ দখলের নৈরাজ্য।

এ ছাড়া ১৯৯৯ সালেই সেন্ট মার্টিনসকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (‘ইসিএ’) ঘোষণার অর্থই হচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থলের ক্ষতি হতে পারে এমন স্থাপনা করা চলবে না। মাটি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করে এমন সব কাজ নিষিদ্ধ থাকবে। এক তলার বেশি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। একই সঙ্গে সেন্ট মার্টিনসে বহুতল অবকাঠামো নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আছে উচ্চ আদালতেরও। তবে এ প্রতিবেদক সরেজমিনে ঘুরে দেখেন, ছোট্ট দ্বীপটি আবাসনব্যবস্থার ভার সইতে পারছে না। ব্যাঙের ছাতার মতো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে দেড় শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ। এর মধ্যে হোটেল ১০৫টি। প্রশাসনের নাকের ডগায় উড়ে উঠেছে এসব স্থাপনা। হোটেল অবকাশ, হোটেল সি ইন, লাবিবা, স্বপ্ন বিলাস, ব্লু মেরিন রিসোর্টসহ ১৫ থেকে ২০টি হোটেল রীতিমতো বহুতল। মালিকরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, ভোলা কিংবা টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী। আছে সরকারি ডাকবাংলো। অনেক আবাসস্থল থেকেই ময়লা-আবর্জনা গিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে দেখা গেল, আবাদি জমিতে ঝুলছে হোটেলের সাইনবোর্ড। দ্বীপবাসীরা জানায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা জমি কিনে গড়ে তুলছেন হোটেল।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধিমালায়-১৯৯৭-এ স্পষ্ট করে বলা আছে, রাতের বেলায় সৈকত এলাকায় আলো জ্বালানো যাবে না; প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক ও শোভাবর্ধক মাছ বিক্রি নিষিদ্ধ। বিদ্যমান আইনে কেউ প্রবাল ও শৈবাল ধরে বিক্রি করলে দুই বছরের কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার শাস্তি রাখা আছে। আইনটি কেউ মানছে না। আইন অমান্যকারীদের ধরতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাউকে চোখে পড়েনি।

ছোট ছোট শিশুরা দিনের বেলায় পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে প্রবাল ও শৈবাল। সন্ধ্যার পর যা দেখা যায়, পরিবেশবিদরা রীতিমতো আঁতকে উঠবেন। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত ‘সমুদ্র বিলাস’-এর চত্বরসহ সৈকতের চারপাশে টং দোকানে প্রকাশ্যে বিক্রি হয় প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক ও শোভাবর্ধক মাছ। আকারভেদে প্রতিটি কাঁকড়ার দাম চল্লিশ থেকে এক শ টাকা। দোকানে দোকানে জ্বলে আলো। পর্যটকবাহী জাহাজ থেকে দ্বীপের পাশে তেল পড়ার কারণেও প্রবাল ও শৈবাল ধ্বংস হচ্ছে। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের প্রায় সবার প্রধান জীবিকা হলো মাছ ধরা। দিনের বেলায় জেলেরা যখন মাছ ধরতে যায়, তাদের জালে বড় মাছের সঙ্গে ধরা পড়ে সামুদ্রিক কাছিম, কাঁকড়াসহ ছোট মাছও। কিন্তু জালে ধরা পড়া এসব সামুদ্রিক প্রাণী ছেড়ে দেওয়া হয় না। ফলে মারা যায় সামুদ্রিক কাছিম, কাঁকড়াসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী। পর্যটকরাও যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। পরিবেশদূষণের কারণে সেন্ট মার্টিনসে অনেক প্রজাতির প্রবাল ও শৈবাল এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে প্রায় ৭০ প্রজাতির প্রবাল রয়েছে। আছে দেড় শতাধিক প্রজাতির মাছ। পাঁচ প্রজাতির কাছিম। তিন শতাধিক প্রজাতির শামুক ও ঝিনুক। যেকোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেয়ালের মতো কাজ করে প্রবাল।

স্থানীয় বাসিন্দা হামিদ উল্লাহ বলেন, সেন্ট মার্টিনস কাছিমের অন্যতম একটি প্রজননকেন্দ্র। কাছিম সাধারণত রাতের বেলায় জোয়ারের সময় ওপরে উঠে এসে ডিম পাড়ে। কিন্তু দ্বীপের চারপাশে আলোর কারণে এবং পর্যটকদের পদচারণ বেড়ে যাওয়ার কারণে কাছিমের আনাগোনা কমে গেছে। এতে করে কাছিমের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেন্ট মার্টিনস ইউনিয়নের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমগীর জানান, শিকারের কারণে কাঁকড়ার প্রজননও কমে গেছে। একই সঙ্গে অতিথি পাখির সংখ্যাও কমে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রহিম মনে করেন, প্রশাসনকে হাত করা ছাড়া টেকনাফ থেকে সমুদ্রপথে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে আনা সম্ভব নয়।

প্রশাসনিকভাবে দ্বীপটি পড়েছে টেকনাফ উপজেলায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনসে কটেজ করার অনুমতি আছে। কিন্তু বহুতলবিশিষ্ট হোটেল করার কোনো অনুমতি নেই। আমরা উচ্ছেদে গেলে আদালতের কাছ থেকে উচ্ছেদের কাজ স্থগিতের কাগজ নিয়ে আসে হোটেল মালিকরা।’ সেন্ট মার্টিনস রক্ষায় পর্যটকের নিয়ন্ত্রণ আনা জরুরি বলে মত দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আদালতের স্থগিতাদেশ দেখানো হয় জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, ‘অবৈধ হোটেল উচ্ছেদে আমরা বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করতে গিয়েছিলাম। স্থানীয়রা লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করতে আসে। কোনোমতে জীবন হাতে রেখে আমরা ফিরে এসেছি।’

সেন্ট মার্টিনস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমেদ বলেন, ‘দ্বীপের পশ্চিম পাশ এরই মধ্যে ভাঙা শুরু হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘সমুদ্র বিলাস’ কটেজের সামনে ভাঙছে। দ্বীপের মাটি খুবই নরম। এখানে যেভাবে স্থাপনা নির্মাণ চলছে, তাতে একদিন এই দ্বীপটি সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র মতে, সেন্ট মার্টিনসের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০০৩ সালে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘উপকূলীয় এবং জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১১ সালে। প্রকল্পের আওতায় ২০০৯ সালে ২৪টি সুপারিশ করা হয়েছিল। সুপারিশে ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করা; ভবন নির্মাণ, পুকুর খননসহ রাস্তাঘাট নির্মাণে পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা; দ্বীপের জমি বহিরাগতদের কাছে বিক্রি হস্তান্তর বন্ধ করা, পর্যটকদের যাতায়াত উত্তর অংশে গলাচিপা পর্যন্ত সীমিত রাখা ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ প্রভৃতি। সুপারিশে আরো ছিল, দিনে কত পর্যটক যাবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া, যা বিশ্বের বিভিন্ন পর্যটনস্থলের সুরক্ষায় মানা হয়ে থাকে। সেন্ট মার্টিনসের ক্ষেত্রে এমন নীতিমালা করা হয়নি।

অবশ্য এর জন্য সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, একক কোনো সংস্থার পক্ষে সেন্ট মার্টিনস রক্ষা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পরিকল্পনা থাকতে হবে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ জন্য নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের আওতায় বেশ কয়েকটি জরিপও হবে। এই প্রকল্পের আওতায় আমরা সামুদ্রিক কাছিম, প্রবাল, শৈবাল রক্ষায় সব ধরনের চেষ্টাই করব।’

পাঠকের মতামত: