বাংলাদেশের স্বর্ণদ্বার হিসেবে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)’ এর মাধ্যমে দেশের ৯২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে। দেশের প্রধানতম ‘সামুদ্রিক বন্দর’ এই চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবস্থান প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতাধিক বছরের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের অনন্য ফসল। এই অর্জন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে প্রশংসীত করেছে বারবার। কিন্তু দীর্ঘদিনের সুনামের পাশাপাশি বন্দরে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টি এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে জনবল সংকট ও নিরাপত্তা বিভাগের প্রতি বেশি জোর দিতে হবে। বন্দরের কার্যক্রমের পরিসরের তুলনায় নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োজিত আছে প্রায় চারভাগের একভাগ। আর বন্দরের আওতাধীন এলাকায় সিসিটিভি’র সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। বিদ্যমান এসব সমস্যা সমাধানে বন্দর কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের বারবার আশ্বস্ত করলেও বাস্তবে এসব দাবি অপ্রতিশ্রুতই থেকে যায়।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে কন্টেনারের ভিতরে করে বহিরাগত লোকের বহি:গমন চেষ্টার ঘটনায় দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা হচ্ছে। এতে করে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের সক্ষমতার বিষয়টি। প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে অনেক সময় পিছিয়ে থাকছে। ২০০১ সালের সর্বশেষ সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযাযী, বন্দরের সংরক্ষিত এলাকার ৩৩৮টি পয়েন্টে কমúক্ষে ১হাজার ৩৬৪ জন নিরাপত্তা রক্ষী থাকার কথা, যা চলতি বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ শ’ ছাড়িয়েছে। এসব সংরক্ষিত এলাকায় মাত্র ৭ শ’ নিরাপত্তা রক্ষী কর্মরত থাকলেও তাদের মধ্যে শতকরা ৫ ভাগ শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান। তাছাড়া আনসার বাহিনী থেকে ধার করে নিরাপত্তা রক্ষীদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টারত বন্দরকে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে নিরাপত্তা বিভাগকে আধুনিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রে পরিমিত জনবল নিয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যতম শাখা হিসেবে ঢেলে সাজাতে হবে।
অন্যদিকে বন্দরের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও চাকরি প্রত্যাশীদের অভিযোগের শেষ নেই। নিরাপত্তা রক্ষী থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগে লক্ষ-কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ ইস্যু। তাছাড়া চট্টগ্রামবাসীকে নিয়োগদানে অনাগ্রাহের ‘গুরুতর অভিযোগ’ও রয়েছে স্থানীয়দের। শিক্ষাগত ও শারীরিক যোগ্যতা থাকার পরেও বিশেষ প্রয়োজনীয়(!) যোগ্যতা না থাকার অযুহাতে বন্দরের যেকোনো পদে নিয়োগলাভে পূর্বে ও বর্তমানে চাকরির আবেদনের সিংহভাগ প্রার্থী চরমভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। নিরপেক্ষভাবে নিয়োগদানে ব্যর্থ ‘চবক’ শিক্ষিত বেকারগোষ্ঠীর সামনে যে জটিলতর নিয়োগপ্রক্রিয়ার অভিযোগ অহরহ শোনা যাচ্ছে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি। প্রচলিত নিয়মের স্রোতে যারা ঘুষ বাণিজ্যে বন্দরের চাকরি নিচ্ছে, তাদের বিষয়ে একটু ভাবুন। বিশাল অংকের ঘুষে এসব নিয়োগপ্রাপ্তরা মানসিকভাবেই দুর্নীতিবাজ হতে বাধ্য হন। কারণ ঘুষের টাকা দেয়ার সামর্থ সবার নেই। তাদের অধিকাংশই উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে এই অকর্মটি(!) সম্পন্ন করেন, তাই ঋণ শোধ করতে গিয়েই ওই কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির প্রচলিত সিস্টেমে আটকে যায় এবং আর সৎ হওয়ার সুযোগ পায়না। তবু আমরা ইতিবাচক স্বপ্নে বিভোর থাকতে চাই। একদিন সব অবিচার-অনিয়মের অবসান ঘটবে সমঅধিকার ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই বন্দরে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে- এটাই লক্ষ লক্ষ বেকারগোষ্ঠীর মনের আকুতি।
আমাদের গর্ব ও অহংকারের অন্যতম দিকপাল ‘চট্টগ্রাম বন্দর’ সম্পর্কে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই জানিনা। সচেতন নাগরিক হিসেবে তাই চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা, বন্দরের সুপরিসর কার্যক্রমের কথা প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। চট্টগ্রামের এক নগণ্য ব্যক্তি হিসেবে এই সুবিশাল স্বায়ত্তশায়িত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটি উপস্থাপনা পরিবেশনের দায়িত্ব অনুভব করছি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ে গড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর। অতিত ইতিহাস পর্যালোচনা করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর। এটি কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ীরা বার্ষিক এক টাকা সেলামির বিনিময়ে নিজ ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন, পরে ১৮৬০ সালে প্রথম দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার গঠিত হয়। ১৮৮৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে দু’টি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়। ১৮৯৯-১৯১০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেংগল রেলওয়ে যুক্তভাবে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে। ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে রেলওয়ে সংযোগ সাধিত হয়। ১৯২৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে ‘মেজর পোর্ট’ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনারকে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট-এ পরিণত করা হয়, বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট-কে চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি’তে পরিণত করা হয়।
স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থা হিসেবে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর, কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর ৯ ধারা মোতাবেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক একটি শুল্ক বন্দর হিসাবে ঘোষিত আমদানি-রপ্তানির সরকারি রুট। চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি’র শীর্ষে রয়েছে একজন চেয়ারম্যান ও ৪ সদস্যের সমবায়ে গঠিত পরিচালনা পর্ষদ। চট্টগ্রাম বন্দরের সমুদ্রসীমা হলো পতেংগা সংকেত কেন্দ্র থেকে সমুদ্রাভিমুখে সাড়ে ৫ মাইল, আর কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে উজানে হালদা নদীর মোহনা অবধি ২৩ মাইল এলাকা চট্টগ্রাম বন্দরের অধিকারভুক্ত এলাকা। কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে উজানে ১০ মাইল পর থেকে জেটি আরম্ভ। বন্দরের স্থায়ী পাকা জেটি ১৫ টি, পল্টুন জেটি ২ টি, বেসরকারি জেটি ৩ টি, লাইটার জেটি ৮ টি, মুরিং বার্থ ১১ টি ও মাল্টি পারপাস বার্থ (কন্টেইনার জেটি) রয়েছে ১২ টি। পল্টুন জেটিসহ মোট ১৭ টি জেটির মধ্যে ১৩ জেটিতে শোরক্রেন ও রেলওয়ে লাইনের সংযোগ আছে। ১১ টি জেটিতে শেড রয়েছে এবং ১৬ ট্রানজিট শেডের মধ্যে মোট আয়তন ১২,৩০,৮৫০ বর্গফুট। ওয়্যার হাউসের মোট আয়তন ৬,৭৭,৫৪০ বর্গফুট ও মাল ধারণ ক্ষমতা ২৭,৬০০ টন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হালিশহর উপকূলে জোয়ার-ভাটার নির্ভরতামুক্ত এলাকায় একটি বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পে ৯০৭ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। বে-টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ হবে প্রায় ৬০০ মিটার। সমুদ্রে জেগে ওঠা চরে বে-টার্মিনালের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। ১৯৯০ সালের পর চরটি জেগে ওঠে যা তীর থেকে প্রায় ৮০০ মিটার দূরের চরটি নতুন একটি চ্যানেলের সৃষ্টি করেছে। বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালসহ সবগুলো জেটিতে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৯ দশকি ৫০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো হয়। বে-টার্মিনাল চালু হলে ১০-১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। বন্দরে সর্বোচ্চ ১৮ শ’ টিইইউএস কন্টেইনার বোঝাই জাহাজ ভেড়ানো যায়, বে-টার্মিনালে ৫ হাজার টিইইউএস কন্টেনার বোঝাই জাহাজ ভেড়ানো যাবে। রাত্রিকালে বঙ্গোপসাগরে চলন্ত জাহাজকে সংকেত প্রদর্শণের জন্য বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর ও সামুদ্রিক এলাকায় ৫ টি বাতিঘর – কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, নরম্যানস পয়েন্ট ও পতেঙ্গা বাতিঘর সক্রিয় আছে।
সুখবর: গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান অধিশাখা-১ থেকে বিশেষ ‘উৎসাহ বোনাস’ প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এককালীন ৩৫ হাজার টাকা করে পাবেন। তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী কমর্রত ছিল তারাই এ বোনাস পাবেন। উপ-সচিব ও তদনিম্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এই বোনাস বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকেই মেটাতে হবে। এতে সরকারের কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে না বলেও নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ১২৯ বছর পূর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় এই ঘাষণা দেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ২০১৫ সালের মধ্যে ২০ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করায় এই ইনসেনটিভ বোনাসের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে ১২৫ বছর পূর্তিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ২৫ হাজার টাকা করে ইনসেনটিভ বোনাস পেয়েছিল। দেশের সচেতন মহল বন্দরের পরিসর উত্তোরত্তর বৃদ্ধি এবং সফলতা কামনায় প্রার্থনারত। কারণ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক।
পাঠকের মতামত: