ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাঁশখালীর ১৫০ ফুটের খাল ভরাট হয়ে ৫০ ফুট!

বাঁশখালীর জলকদর খালের বাহারছড়া অংশে খালের পার দখল করে এভাবে গড়ে উঠছে শত শত স্থাপনা।

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি ::  বাঁশখালীর ১০ লাখ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ জলকদর খাল। খালটি ১৫০ ফুট প্রস্থ ছিল। বর্তমানে ভরাট হয়ে ৫০ ফুটে ঠেকেছে। কোথাও কোথাও ৩০ ফুটে এসে ঠেকেছে। ৪৫ বছর ধরে খনন করার উদ্যোগ না নেওয়ায় খালের ভরাট অংশে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৮ হাজার ঘরবাড়ি, দোকানপাট এবং বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদাররা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ২ শতক জমির দখলিস্বত্ব বিক্রি করছে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। তারপর রাতারাতি গড়ে উঠছে জলকদর খালের ভরাট অংশে অবৈধ স্থাপনা।

বেসরকারিভাবে পরিচালিত ইউনিয়নভিত্তিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ হাজার অবৈধ স্থাপনার স্থানীয়ভাবে বিক্রয় মূল্য দাঁড়িয়েছে ২০০ থেকে ২২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত দখলের পর বিক্রি হচ্ছে শত শত একর খালের চর। ফলে জলকদর খাল দিয়ে সহজে চলাচল করতে পারছে না ফিশিং বোট, বাণিজ্যিক বোট ও জেলেদের নৌকা। খালের বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলায় স্বাভাবিক পানি চলাচল করতে না পারায় খাল শুকিয়ে যাচ্ছে। খনন করে জোয়ার-ভাটা প্রবাহিত করা গেলে খালে নৌ চলাচল স্বাভাবিক হতো।

সরকারি হিসাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে শতকপ্রতি বার্ষিক লিজের মূল্য ১০০ থেকে ২০০ টাকা। সরকারিভাবে লিজ দিতে গেলে কর্মকর্তারা ঘুষ পান কম। দখলদাররা ২ শতক জমির দখলিস্বত্ব বিক্রি করে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। এর জন্য কমিশনও দেন বেশি। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দখলদারদের বাধা দেওয়ার পরিবর্তে উল্টো উৎসাহ দেন। জেগে ওঠা চরের জমি অস্থায়ী ভিত্তিতে পেতে সরকারি নিয়মে শত শত মানুষ লিজের জন্য আবেদন করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমি ও রাজস্ব শাখার সংশ্লিষ্টরা লিজ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

খানখানাবাদ চৌধুরীঘাটের শামসুল আলম নামে এক ব্যক্তি জানান, জলকদর খালের জেগে ওঠা ৮০ শতক জায়গা দীর্ঘদিন ধরে এক ব্যক্তি অবৈধভাবে দখল করে আছে। সেখানে অবৈধ স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়েছে। নিজের জমির মতো দখলিস্বত্ব বিক্রি করে অন্তত ৩০ লাখ টাকা কামিয়ে। অথচ ওই জায়গা লিজের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজস্ব শাখায় আবেদন করেও পাঁচ বছর ধরে লিজ পাওয়া যায়নি।

বাহারছড়া ইউনিয়নের মোশারফ আলী হাটের আবু ছালেক। তিনি জানান, তাঁর বাড়ির চারদিকে জলকদর খালের পার দখল করে অন্তত ২০০টি ঘর ও দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি নিজেও আট শতক জায়গার ওপর পাকা ঘর নির্মাণ করেছেন। জায়গাটির দখলস্বত্ব কিনেছেন সাড়ে চার লাখ টাকায়। প্রতি বছর পাঁচ হাজার টাকা দখলস্বত্বের ভাড়া আদায় করেন আব্দুর রহিম। দখলদারদের প্রতি বছর ভাড়া দেওয়ার চেয়ে সরকারি কোষাগারে টাকা দিয়ে লিজ নিতে পারলে জায়গাটা স্থায়ী হতো। এর জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে চার বছর আগে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু লিজ পাওয়া যায়নি। তদন্তে এসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দখলস্বত্ব বিক্রয়কারী দখলদারদের সঙ্গে বৈঠক করে ফিরে যান।

লিজের জন্য আবেদন করেও লিজ না পাওয়া নিয়ে অভিযোগ করেন কাথারিয়া চুনতি বাজারের আব্দুর রহমান, ফোরমান আলী ও রহমত উল্লাহ; সরল বাজারের নবী হোসেন, রশিদ মিয়া, আয়শা বেগম; জালিয়াখালী বাজারের আলী নবী।

কাথারিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শাহজাহান খান বলেন, ‘বাঁশখালীর জলকদর খাল হচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। কোটি কোটি টাকার আহরিত লবণ, সামুদ্রিক মাছ ও দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর পণ্য এ খাল দিয়ে পরিবহন করা হয়ে থাকে। খালটির ৭৫ শতাংশ ভরাট হয়ে অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বাঁশখালীর স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে খালটি পুনঃ খননের পাশাপাশি অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা দরকার।’

সরল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। দখলদারদের কবল থেকে জলকদর খাল রক্ষা করে খনন করা জরুরি।’

বাঁশখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বেড়িবাঁধ বা খালের পার রক্ষার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমি ও রাজস্ব শাখার। তারা বৈধ ও অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে। তারা যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে তাহলে আমার কিছু করার নেই।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁশখালীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক (ভূমি ও রাজস্ব শাখা) আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে লিজ দিয়ে থাকি। তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠালে তা অনুমোদন হয়। মানুষের অভিযোগ হরেক রকম হতে পারে। খালটি খননের উদ্যোগ নিলে সব অভিযোগ দূর হবে।’

পাঠকের মতামত: