ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

অনিয়মের বাসা চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল!

* আড়াই মাসে বিশেষায়িত তিন হাসপাতালে অবহেলায় রোগীর ‘মৃত্যু’সহ নানা অভিযোগ
* চিকিৎসক, নার্সসহ স্থায়ী লোকবলের চরম সংকট

* সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার অভিমত বিশেষজ্ঞদের

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::

চট্টগ্রাম নগরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বাসা বেঁধেছে। চিকিত্সক, নার্সসহ স্থায়ী লোকবলের চরম সংকট রয়েছে হাসপাতালগুলোতে। শুধু তাই নয়, বেশির ভাগ হাসপাতালে অদক্ষ লোকবল কর্মরত। এসব বিষয়ে কোনো সরকারি নজরদারিও নেই। এ সুযোগে যে যেভাবে পারছে সেভাবেই পরিচালনা করছে হাসপাতাল। এসব কারণে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে।

কোথাও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেই কেবল তোলপাড় হয় ওই হাসপাতাল নিয়ে। তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছুদিন পর পর চিকিত্সাসেবা নিয়ে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

গত প্রায় আড়াই মাসে নগরের বিশেষায়িত তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে অবহেলায় রোগীর ‘মৃত্যু’ ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনার তদন্তে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে ওঠে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হলেও হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি লক্ষ করা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, ওই সব নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সরকারিভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। কিছু বেসরকারি হাসপাতালের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে অন্যদের বদনাম হচ্ছে। তবে বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। নেই স্থায়ী লোকবল কাঠামো। যে যার ইচ্ছামতো হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করছে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে নগরের অন্যতম প্রধান বেসরকারি ম্যাক্স হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক লিমিটেডে ‘ভুল চিকিত্সায়’ রাইসা নামে দুই বছর তিন মাস বয়সী এক শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা নিয়ে এখনো তোলপাড় চলছে। এ নিয়ে দুটি তদন্ত কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে গতকাল রবিবার।

এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল রাতে একটি তদন্ত দল চট্টগ্রাম এসে ওই হাসপাতালে গেছে। মন্ত্রীর নির্দেশে তদন্ত দল চট্টগ্রাম এসেছে বলে জানা গেছে।

ওই ঘটনায় প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে ম্যাক্স হাসপাতালের এক চিকিৎসকসহ তিনজনকে। তাদের মধ্যে চিকিৎসক দেবাশীষ সেনগুপ্তকে তদন্তের স্বার্থে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডা. দেবাশীষের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আগেও ছিল বেসরকারি একটি হাসপাতালে। আগে নগরের বেসরকারি রয়েল হাসপাতালে তিনি কর্মরত ছিলেন। সেখানে এক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক এক রোগীর অস্ত্রোপচার করেছিলেন। পরে ভোররাতে হঠাত্ রক্তক্ষরণ শুরু হয় ওই রোগীর। ওই সময় ডা. দেবাশীষ ডিউটিতে ছিলেন। তাঁকে বিষয়টি জানানো হলেও তিনি দেখতে যাননি। বিষয়টি সবার নজরে এলে ডা. দেবাশীষকে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৌখিক নির্দেশে তাঁর বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা নেয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
ম্যাক্স হাসপাতালে শিশু রাইসার মৃত্যুর ঘটনায় গত শুক্রবার রাতে চকবাজার থানা পুলিশ ডা. দেবাশীষ, নার্স শিউলি ও সুপারভাইজার মাকসুদুল হক ভুঁইয়াকে আটক করলেও প্রায় তিন ঘণ্টা পর তাঁদের ছেড়ে দেয়। জানা যায়, শিউলিকে নার্স হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তাঁর নার্সিং শিক্ষাই নেই।

এ বিষয়ে জানতে ম্যাক্স হাসপাতালে নার্সিং বিভাগের কর্মকর্তা মো. জামিলের সঙ্গে গতকাল কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। একপর্যায়ে সন্ধ্যায় ফোন বন্ধ করে দেন। তবে ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লেয়াকত আলী খান গত শনিবার বিকেলে শিউলিকে নার্স হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু তাঁর পুরো নাম তিনি বলতে পারেননি।

এর আগে ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় ‘চাইল্ড কেয়ার’ নামক বেসরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে নোয়াখালী থেকে আসা রোকসানা আক্তারের দুই দিন বয়সী মেয়ে নবজাতককে ভর্তি করা হয়েছিল। তিন দিন পর প্যাকেট মোড়ানো ‘মৃত এক নবজাতক’ দেওয়া হয়েছিল রোকসানার স্বজনদের। গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফনের আগে গোসল করানোর সময় স্বজনরা দেখেন পুরুষ নবজাতক। এরপর রাতেই মৃত ওই নবজাতককে চট্টগ্রামে নিয়ে এসে বিষয়টি পাঁচলাইশ থানাকে অবহিত করা হয়। পরে পুলিশ চাইল্ড কেয়ারে গিয়ে রোকসানা আক্তারের মেয়ে নবজাতককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল।

গত ২২ মে নগরের চকবাজার এলাকার বেসরকারি পিপলস হাসপাতালে মৃত নবজাতক স্বজনদের বুঝিয়ে না দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরে সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের আবর্জনাবাহী গাড়িতে করে ডিপোতে ফেলা হয় ময়লা। সেখান থেকে উদ্ধার করে মৃত নবজাতককে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জানা যায়, আগের দুটি ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুটি এবং স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটিতে পিপলস এবং চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম অব্যবস্থাপনার তথ্য উঠে এলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

এসব বিষয়ে গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. এ এম মজিবুল হক বলেন, ‘বেসরকারি কোনো হাসপাতালে চিকিত্সাসেবা কার্যক্রমে কোনো অভিযোগ উঠলে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা তদন্ত করে থাকি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিই। তবে যেসব ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার নেই সেগুলো আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠাই। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীতে দুটি ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত কমিটি করা হয়। প্রতিবেদনে বিভিন্ন অনিয়ম উঠে এসেছে। ওই দুটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। আমরা তাদের শোকজ করেছিলাম।’

চট্টগ্রামের জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মনিটরিং জোরদার করতে হবে। তবে সব হাসপাতালে যে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমরা যেখানে অভিযোগ পাচ্ছি সেখানে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর যেগুলোতে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার সেগুলো নিচ্ছি, যা আমাদের এখতিয়ার নয় তা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হচ্ছে। তবে একটি তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্ত চিকিত্সকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএমডিসির কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।’

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিত্সাসেবায় বড় অবদান রাখছে। কিন্তু কয়েকটি হাসপাতালের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে সব হাসপাতালের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বলতে গেলে প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতালের সেবার মান খারাপ না। তবে কিছু বেসরকারি হাসপাতালে মাঝেমধ্যে তদন্তে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নানা ধরনের সংকট আছে। স্থায়ী ও অভিজ্ঞ-প্রশিক্ষিত লোকবলের সংকট রয়েছে অনেক হাসপাতালে। স্থায়ী লোকবলের অভাবে অনেক সমস্যা হচ্ছে। তদন্তে হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা বিভিন্ন সুপারিশ-পরামর্শ দিয়েছি।’কালের কন্ঠ

পাঠকের মতামত: