ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

তনুর মা আনোয়ারা বেগম: ঘাতক শনাক্তে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাই

5_41290নিউজ ডেস্ক :::

‘আমার সোহাগীর যখন ২ বছর বয়স তখন তাকে নিয়ে সেনানিবাসের নতুন বাসায় উঠি। সেখানেই তার বড় হওয়া। অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে। সেই বুকের ধনের লাশ সেখান থেকে নিয়ে বাড়িতে মাটিচাপা দিয়েছি। তাকে হারিয়ে বুকে যে আগুন জ্বলছে ন্যায়বিচার না পেলে সে আগুন নিভবে না। তাই আমার বুকের ধনের ঘাতকদের শনাক্তে এবং তাদের গ্রেফতারে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাই। যেহেতু সেনানিবাস এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে তারা সহযোগিতা করলে অপরাধী শনাক্ত করা সহজ হবে।

যুগান্তরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের নিহত ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মা আনোয়ারা বেগম। ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার একটি জঙ্গল থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়।

এক ঘণ্টারও বেশি সময়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তনু হত্যাকাণ্ড, ২টি ময়নাতদন্তে চিকিৎসকদের ভূমিকা, পরিবারকে হয়রানিসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। মুরাদনগর উপজেলার কামাল্লা গ্রামে আনোয়ারা বেগমের মামার বাড়িতে বসে শুক্রবার এ সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।

আনোয়ারা বেগম বলেন, আমার সোহাগীকে যখন জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয় তখন তার শরীর রক্তাক্ত ও থেঁথলানো ছিল। কিন্তু ময়নাতদন্তের সময় ডাক্তাররা তা দেখলেন না। ডাক্তারদের সঙ্গে ঘাতকদের শখ্যতা থাকায় মৃত্যুর কারণ উল্লেখ না করে ভুল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। তাই ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনের আওতায় নেয়া হলে মৃত্যুর রহস্য বের হয়ে আসবে।

সোহাগী জাহান তনু। আদর করে পরিবারের সদস্যরা তাকে সোহাগী বলেই ডাকতেন। বাবা ইয়ার হোসেনের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে চাকরির সুবাদে জন্মের দুই বছর পর জেলার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রাম থেকে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার বাসায় মায়ের সঙ্গে তার আসা। সেনানিবাসের পাঠশালা থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস বিভাগে। লেখাপড়ার পাশাপাশি নৃত্য ও নাট্যচর্চার জন্য যোগ দিয়েছিল ভিক্টোরিয়া থিয়েটারে। বাবা-মা, দুই ভাই ও এক বোনের পরিবারের কনিষ্ঠ হিসেবে প্রতিটি সদস্যই তাকে আদরের বেড়াজালে জড়িয়ে রাখত।

তনুর মা জানান, ‘ছোট বেলা থেকেই সোহাগী সেনানিবাসের যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিত। বিনিময়ে হয়তো একটি মগ-গ্লাস উপহার পেত। কখনোই অর্থের বিনিময়ে সে গান গাইত না।’

হত্যাকাণ্ডের রাতের কথা স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘সাধারণত বাসায় ফিরতে দেরি হলে সোহাগী আমাকে মোবাইলে কল করত। কিন্তু রাতে সে বাসায় না ফেরায় বুকটা কেঁপে উঠছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন ঝোপের ভেতর তার লাশ পাই, তখন আমার স্বামী মিলিটারি পুলিশের সহযোগিতায় মেয়ের লাশ উদ্ধার করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেয়ার পর থেকেই আমাদের সোহাগীর লাশের পাশে থাকতে দেয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের গোটা শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। কাপড় ছেঁড়া, চুল কাটা, কান দিয়ে তাজা রক্ত ঝরছিল, হাত-পায়ে বুটের আঘাতের চিহ্ন- এসব আমি নিজের চোখে দেখেছি।’

ময়নাতদন্তে ভুল রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ‘সিএমএইচ হাসপাতালে পুলিশ-ডাক্তার মিলে যে সুরতহাল করেছে তাতে কিছু লেখার আগেই আমাদের স্বাক্ষর নেয়া হয়। ময়নাতদন্তের জন্য সেখান থেকেই লাশ নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে। সাধারণত ময়নাতদন্তের জন্য সর্বোচ্চ ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগলেও তনুর ময়নাতদন্ত করতে সময় নেয়া হয়েছে ৬ ঘণ্টা। প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক শারমিন সুলতানা তনুর লাশের ময়নাতদন্তের সময় বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলেছেন। এ সময় ডা. শারমিন কার সঙ্গে কথা বলেছেন, তা তদন্ত করলেই বেড়িয়ে আসবে।’

দুটি ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ না থাকা প্রসঙ্গে আনোয়ারা বেগম বলেন, ডা. শারমিন ও কেপি সাহা ঘাতকদের সঙ্গে আলাপ করে পরিকল্পিতভাবে আমার মেয়ের হত্যার আলামত লুকিয়েছেন এবং মিথ্যা-বানোয়াট প্রতিবেদন দিয়েছেন। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারী চিকিৎসকদের গ্রেফতার ও আইনের আওতায় আনলেই কারা ঘাতক বেড়িয়ে যাবে।’

আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে হত্যার পর আমাকে এবং আমার পরিবারকে নানাভাবে মানসিক চাপের মুখে রাখা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর বেশ কয়েকদিন অবরুদ্ধ জীবনযাপন করেছিলাম। মনে হয়েছিল মেয়ের মতো আমাদের পুরো পরিবারকে মেরে ফেলা হবে। ২৪ ঘণ্টাই পাহারা দেয়ার নামে নানা হুমকি-ধমকি দেয়া হতো। আশপাশের সব পরিবারের কাছ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। পরে ঘটনার কয়েকদিন পর কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার আমাদের পাশে দাঁড়ান এবং নানা পদক্ষেপ নিয়ে তিনি পারিপার্শি^ক ও মানসিক নির্যাতন থেকে আমাদের মুক্ত করেন।’

তিনি বলেন, ‘সেনানিবাসে যাদের সঙ্গে চলাফেরা করে আপনজনের মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম, হুমকির মুখে তারাই এখন আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। আশপাশের লোকগুলোকে আমাদের দিকে তাকানো পর্যন্ত নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। এখন মেয়ে হারানোর শোকে অনেকটাই পাথর হয়ে একাকী জীবনযাপন করছি। বাসা থেকে বের হয়ে কোথাও যেতে হলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পেছনে লোক লেগে থাকে আমরা কোথায় যাই তা ফলো করার জন্য।’

তনুর মা বলেন, ‘ফাইনাল পরীক্ষার কারণে আমার মেয়ে সেনাকল্যাণের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু। হত্যাকাণ্ডের দু’দিন আগে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে সোহাগী শ্রীমঙ্গলে চলে যায়। তাই সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে তার গান গাওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘যেখানে মেয়েকে নিরাপদ মনে করতাম সেখানেই পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন ও ধর্ষণ করে আমার মেয়েকে হত্যা করা হল। আমরা সেনাবাহিনীকে ভালোবাসি, তারা দেশের সম্পদ, আমাদের শত্র“ নয়। আমরা তো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। তনুর ঘাতকদের বিরুদ্ধে কথা বলছি। ২/১ জন ঘাতকদের জন্য অন্যরা কলংকিত হতে পারে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’

আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে অপরাধীরা অনেকটাই স্বস্তিতে আছে। অপরাধী শনাক্ত করা এত কঠিন কাজ নয়, তারা তো আশপাশেই আছে। তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে মেয়েকে গ্র্যাজুয়েট বানাতে চেয়েছিলাম। তাকে হারানোর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না, নানা প্রকার হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে, আমি এসব আর পরোয়া করি না। মেয়ে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে জীবন চলে গেলেও আপত্তি নেই।’

তনুর মা বলেন, সিআইডির কর্মকর্তারা বাসায় গিয়ে গত বুধবার আবারও সোহাগীর বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। সিআইডির এসপি ড. নাজমুল জানিয়েছেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ না থাকলেও ডিএনএ প্রতিবেদন দিয়েই বিচার সম্ভব।’

তনুর মা আরও জানান, ঈদের পর ঘাতক শনাক্ত করা হবে এবং গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে সিআইডি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরা এখন সেই অপেক্ষায় আছি।’

পাঠকের মতামত: