নিউজ ডেস্ক :: কক্সবাজারে চলমান ইয়াবা বিরোধী অভিযানের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাচ্ছে চুনোপুঁটিরা।
জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিরা বন্দুকযুদ্ধের শিকার হলেও পার পেয়ে যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ কারবারিরা। অথচ মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার করে এনে দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই শীর্ষ কারবারিদের বিরুদ্ধে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ও জেলা পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ৫২ জন। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাত্র চারজন। বাকি ৪৮ জনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার বাইরের। তবে জেলা পুলিশের তালিকায় তাদের নাম রয়েছে।
তালিকার শুরুতে লেখা রয়েছে, ‘মাদক চোরাকারবারি ও সরবরাহকারীদের পৃষ্ঠপোষক/আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বরসহ নামীয় তালিকা’। এরপর তালিকার ১ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম। তালিকায় বদির একাধিক স্বজনসহ ৭৩ জন শীর্ষ পাচারকারীর নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর স্থান পেয়েছে।
বর্তমানে কক্সবাজারে আয়োজন করে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া চলছে। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে টেকনাফে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ করতে পারে বলে জেলা পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে শতাধিক ব্যক্তি পুলিশের হেফাজতে চলে গেছে। সর্বশেষ বিদেশ থেকে ফিরে গত বুধবারও ২০ জনের বেশি ব্যক্তির হেফাজতে যাওয়ার কথা ছিল। তবে তাদের নামের তালিকা বা সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ছাড়াও জেলা পুলিশের যে তালিকা রয়েছে, এই তালিকায় এক হাজার ১৫০ ব্যক্তির নাম স্থান পেয়েছে। মূলত জেলাজুড়ে গত কয়েক বছরে দায়ের করা মামলার আসামিরাই এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলা পুলিশ মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক কারবারিদের তথ্যাদি আলাদাভাবে আরেকটি তালিকায় লিপিবদ্ধ রাখছে।
ওই তালিকায় গত বছরের ২৪ মে থেকে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯ মাসে বিভিন্ন সময়ে জেলায় বন্দুকযুদ্ধ, মাদক কারবারিদের অন্তঃকোন্দলে মৃত্যু, মাদক কারবারিদের অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার সংক্রান্ত তথ্যাদি রয়েছে। ওই তালিকায় ৫৪ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে মূলত পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে। তবে তালিকায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুজন জলদস্যুর মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। সেই হিসাবে জলদস্যু বাদে ৫২ জন মাদক কারবারির মৃত্যু হয়েছে।
নিহতের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত চারজন হলো তালিকার ২৩ নম্বর ক্রমিকের আকতার কামাল মেম্বার (৩৬), তালিকার ২৭ নম্বর ক্রমিকের হাবিব উল্লাহ হাবিব (৩৫), তালিকার ৩১ নম্বর ক্রমিকের জিয়াউর রহমান এবং তালিকার ৫৬ নম্বর ক্রমিকের মোস্তাক আহমদ মুছু।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত এই চার ইয়াবা কারবারির মৃত্যুর বিষয়টি কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু নিহতের তালিকায় দেখা গেছে, পুলিশ আরো তিনজনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ওই তিনজনের নাম পাওয়া যায়নি।
গত ২০ জানুয়ারি টেকনাফ থানার হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া এলাকায় টেকনাফ থানার পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় শামসুল আলম ওরফে বার্মাইয়া শামসু (৩৮)। টেকনাফ থানার পূর্ব সিকদার পাড়ার হোসেন প্রকাশ গুরা মিয়ার ছেলে শামসুর। আবার গত ১০ জানুয়ারি টেকনাফের সাবরাং মেরিন ড্রাইভ সড়কের জিরো পয়েন্ট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় ১০ মামলার আসামি রশিদ আহাম্মদ ডেইলা ও দুই মামলার আসামি আবুল কালাম। এই তিনজনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তাদের নাম তালিকায় পাওয়া যায়নি।
বন্দুকযুদ্ধে ছোট কারবারিদের বেশি মৃত্যু হচ্ছে, এই ভয়ে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে ইয়াবা কারবারি জাফর আহমদ ও আলী আহমদ। এ দুজনই টেকনাফের বাসিন্দা। আলাপকালে তারা জানায়, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বন্দুকযুদ্ধের নামে চুনোপুঁটি বেশি মারছে। তাই জীবন রক্ষার্থে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭৩ জনের তালিকার মধ্যে মারা পড়েছে মাত্র চারজন। বাকি ৬৯ জনের মধ্যে ২৩ জন আত্মসমর্পণ করতে পুলিশ হেফাজতে গেছে বলে জানা গেছে। তবে গতকাল বুধবার নতুন করে আরো কয়েকজন পুলিশ হেফাজতে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি কতজন আছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর আগে ২৩ জনকে পুলিশ হেফাজতে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পুলিশ হেফাজতে যাওয়া শীর্ষ মাদক কারবারিদের মধ্যে রয়েছে টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই (৪ নম্বর) আবদুল আমিন, (৫ নম্বর) মো. নুরুল হুদা মেম্বার, (৮ নম্বর) দিদার মিয়া, বদির ভাগিনা (১১ নম্বর) সাহেদুর রহমান নিপু, বদির ভাই (১৬ নম্বর) মো. সফিক, বদির ভাই (১৭ নম্বর) মো. ফয়সাল, (১৮ নম্বর) এনামুল হক মেম্বার, (২১ নম্বর) ছৈয়দ হোসেন মেম্বার, বদির বেয়াই (২৪ নম্বর) শাহেদ কামাল, (৩৩ নম্বর) শাহ আলম, (৩২ নম্বর) আবদুর রহমান, (৩৩ নম্বর) মোজাম্মেল হক, (৩৪ নম্বর) জোবাইর হোসেন, (৩৫ নম্বর) নূরুল বশর ওরফে নুশ্সাদ, (৩৬ নম্বর) কামরুল হাসান রাসেল, (৪০ নম্বর) আব্দুর রহমান, (৪১ নম্বর) জিয়াউর রহমান, (৪৬ নম্বর) মো. নুরুল কবির, (৪৭ নম্বর) মারুফ বিন খলিল প্রকাশ বাবু, (৫০ নম্বর) মো. ইউনুছ, (৫২ নম্বর) ছৈয়দ আহমদ ছৈয়তু, (৫৪ নম্বর) জামাল হোসেন মেম্বার ও (৬৩ নম্বর) রেজাউল করিম।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৭৩ জন ইয়াবা কারবারির মধ্যে বাকি ৪৬ জন এখনো আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার বাইরে আছে। তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিদের মধ্যে বাইরে থাকা অন্যতম হলো সাবেক সংসদ সদস্য (১ নম্বর) ক্রমিকের আবদুর রহমান বদি, (২ নম্বর) হাজি সাইফুল করিম, বদির ভাই (৩ নম্বর) আবদুস শুক্কুর, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলার আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি (৬ নম্বর) জাফর আহমদ, (৭ নম্বর) মোস্তাক মিয়া, (৯ নম্বর) মোহাম্মদ শাহজাহান চেয়ারম্যান, (১০ নম্বর) মোহাম্মদ ইলিয়াছ, বদির ভাই ও টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর (১৫ নম্বর) মৌলভি মুজিবুর রহমান, (২৫ নম্বর) মৌলভি আজিজ, (২৬ নম্বর) মৌলভি রফিক উদ্দিন প্রমুখ।
অন্যদিকে শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে মৌলভি মুজিবুর রহমান, মৌলভি আজিজ, মৌলভি রফিক এবং রামু থানার একজন শীর্ষ কারবারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তদবির করেছে তাদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ তো ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে মারছে না। ইয়াবা কারবারিদের ধরার সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়েছে। আবার বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে মাদক কারবারিদের অন্তঃকোন্দলের কারণে গোলাগুলিতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিদের মধ্যে কতজন পুলিশ হেফাজতে গেছে—এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন পুলিশ সুপার।কালের কন্ঠ ::
পাঠকের মতামত: