নিউজ ডেস্ক ::
নূরুল হক ভুট্টোর ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্যরাদুই ভাই নুরুল হক ভুট্টো এবং নূর মোহাম্মদ। তাদের বাবা এজাহার মিয়া। আরও আছে তাদের পাঁচ ভাগ্নে— জালাল উদ্দিন, বেলাল উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন এবং হোছেন ওরফে কামাল উদ্দিন। কক্সবাজারের টেকনাফের বাসিন্দা এই আট জনে মিলে গড়ে তুলেছিল ইয়াবা ব্যবসার পারিবারিক এক সিন্ডিকেট।
টেকনাফ থেকে সারাদেশে ইয়াবা পাঠাতো তারা। ঢাকার মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদীতে তাদের রয়েছে আলাদা আলাদ সাব-সিন্ডিকেট। ইয়াবা ব্যবসা করে নুরুল হক ভুট্টো, নূর মোহাম্মদ এবং তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সরাসরি ব্যাংকের হিসাব ছাড়াও ‘বিকাশ’ এবং ‘রকেট’ ব্যবহার করে ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত কোটি টাকার লেনদেনের হিসাব পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
পরে দুই ভাই নুরুল ও নূর, তাদের বাবা এবং পাঁচ ভাগ্নের মধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় মানিলন্ডারিং আইনে সিআইডির পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের একটি মাদক মামলার (মামলা নম্বর ১২, তারিখ: ৩ এপ্রিল ২০১৭) তদন্ত করতে গিয়ে এই বিশাল ইয়াবা সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছেন তারা। এই সিন্ডিকেটটি এত বড় যে, তদন্ত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গোয়েন্দারা আরও জানান, দীর্ঘ দিন ধরে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই চক্রটি ইয়াবার চালান পাঠিয়ে আসছিল। সিন্ডিকেটটি যাদের কাছে ইয়াবা পাঠাতো, তারা হয় ব্যাংক অথবা মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেল বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতো। এসব সূত্র ধরে পুরো সিন্ডিকেটের সব সদস্যকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
বাঁ থেকে বাবা এজাহার মিয়া, দুই ভাই- নূর মোহাম্মদ ও নূরুল হক ভুট্টোপুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা অনেক বড় একটি ইয়াবা কারবারির সিন্ডিকেট। মাদক মামলার সূত্র ধরে অনুসন্ধানের পর এই সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে একটি মামলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের উপ-গ্রুপগুলোকে শনাক্ত করে তাদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।’
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ থানার নাজিরপাড়া এলাকার বাসিন্দা এজাহার মিয়া। তার দুই ছেলে নূরুল হক ভুট্টো ও নূর মোহাম্মদ। সিন্ডিকেটটির মূল নেতৃত্ব দেয় নূরুল হক ভুট্টো। সে মূলত ২০০৮ সালে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে। সে ২০১৩ সাল থেকে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তার বাবা ও আরেক ভাইকেও যুক্ত করে। সঙ্গে নেয় বোনের পাঁচ ছেলেকেও। নূরুল হকের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এই সাত জন। এছাড়া, এই চক্রে আছে ভুট্টোর আপন চাচাতো ভাই হামিদ, আর আরিফ নামে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা টেকনাফের আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকে হিসাব খুলে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা বিক্রির অর্থ সংগ্রহ করতো। এছাড়া, টেকনাফে স্টার ফার্মেসির বিকাশ ও রকেট এজেন্ট আব্দুর রহমান, মোবাইল গ্যালারির নূরুল মোস্তফা, হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্সের মোহাম্মদ হাসান, মোজাহার স্টোরের মোজাহার আলম, আবু তাহের নামে এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত চারটি বিকাশ ও রকেট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইয়াবা বিক্রির টাকা সংগ্রহ করা হতো।
বাঁ থেকে ফয়সাল, সোহেল, ইব্রাহীম, রানী ও রূপাবাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানতে পারেন, সিন্ডিকেটের মূল হোতা নূরুল হক ভুট্টোর আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে (হিসান নং ১০২১২২০০০১৩৯২) ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে গত বছরের ৬ জুলাই পর্যন্ত ৫৭ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫৪ টাকা জমা হয়। অগ্রণী ব্যাংকের হিসাবে (হিসাব নং ২০০০১৩৯০৩) ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা হয় ২৯ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০ টাকা। এছাড়া, জনতা ব্যাংকের হিসাবে (হিসাব নং ০৮৯৯৩৪০১৫২৮৮) ২০১২ সালের ২৯ মে থেকে ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮ লাখ তের হাজার পাঁচশ টাকা জমা হয়।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, নূরুল হক ভুট্টোর ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের হিসাবে (হিসাব নম্বর ১০২১০২০০০০৮৫৯) ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে গত বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত এক কোটি ১০ লাখ ২৯ হাজার ৮৮০ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের হিসাবে (হিসাব নম্বর ২০০০১৩৩৬৭) ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৫২ লাখ ৮৫ হাজার ৮০০ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের হিসাবে (হিসাব নম্বর ২০৫০১৪৭০১০০২৮২৪১৫) ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত এক কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার ৭৩১ টাকা জমা হয়।
বাঁ থেকে ওপরে- তৈয়ব, জালাল, নূরুল মোস্তফা, বেলাল, বাঁ থেকে নিচে- রাশেদ, আফসার, রহমান ও আরিফতদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, চারটি ব্যাংকের আটটি হিসাবে দুই ভাই ও তার বাবার কাছে ছয় বছরে চার কোটি ৬৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩২৯ টাকা জমা হয়েছে। এসব হিসাব পর্যালোচনা করে সিআইডির কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব টাকা তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। ইয়াবার চালান পাঠানোর পর বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এসব টাকা নূরুল হক ভুট্টো, নূর মোহাম্মদ ও তাদের বাবা এজাহার মিয়ার ব্যাংক হিসাবে পাঠায়। এর বাইরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অন্তত শতাধিক বিকাশ ও রকেট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও ইয়াবার টাকা গ্রহণ করে তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইয়াবা ব্যবসার এই চক্রটির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দায়ের করা হয় গত বছরের ২৯ আগস্ট। এসময় দুই ভাই নূরুল হক ভুট্টো, নূর মোহাম্মদ, দুই ভাগ্নে জালাল ও বেলালসহ মাদক বিক্রির অর্থ লেনদেনে সহায়তা করার জন্য আরিফ, আব্দুর রহমান, নুরুল মোস্তফা, মোহাম্মদ তৈয়ব, রাশেদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে অন্য তিন ভাগ্নে আবছার, হেলাল ও কামাল এবং মাদক বিক্রির অর্থ লেনদেনে সহযোগিতার জন্য বিকাশ ও রকেট এজেন্ট মোহাম্মদ হাসান, মোজাহার আলম, আবু তাহের ও মোহাম্মদ হামিদকে আসামি করা হয়েছে।
ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা সবাই পাঁচ-ছয় বছর আগেও দিন মজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্তমানে তারা বিলাসবহুল বসতবাড়ি, গাড়িসহ কোটি কোটি টাকার জায়গা-সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক। ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে তারা এসব অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়েছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘এটি একটি বিশাল চক্র। এই চক্রের এপর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয় জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে তিন জন হলো মূল হোতা। তাদের আরও সহযোগীদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
চক্রের সহযোগী গ্রুপগুলোও পুলিশের কব্জায়
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টেকনাফের এই চক্রটি সারাদেশে যাদের কাছে ইয়াবা পাঠাতো, তার মধ্যে তিনটি ইয়াবা ডিলার চক্রের ১৩ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এর মধ্যে অন্যতম একজন ইয়াবার ডিলার হলো— গাজীপুরের সুমাইয়া আক্তার রানী। তার সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসা করতো ফয়সাল ও ইব্রাহীম নামে আরও দুজন। আর ইয়াবা বিক্রির টাকা গ্রহণ করতো নাছির ও ফেমাস টেলিকম নামে দুই বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে। রানীকে এ বছরের ২ মার্চ নাঈম নামে একসহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয়। একই দিনে গ্রেফতার করা হয় সহযোগী নাছির টেলিকমের সোহেল ওরফে নাছির এবং ফেমাস টেলিকমের শাহজালালকে। দুদিন পর ৫ মার্চ গ্রেফতার করা হয় আরেক সহযোগী ইব্রাহীমকে। সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, গাজীপুরের নাছির ও ফেমাস টেলিকমের মাধ্যমে রানী ইয়াবা বিক্রির এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা গ্রহণ করে।
টেকনাফের এই পারিবারিক ইয়াবা চক্রের আরেকজন ডিলার হলো মিরপুরের রূপা ইসলাম। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয় তাকে। এর তিন দিন পর এ বছরের ১ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয় রূপার স্বামী আল-আমিনকে। রূপা তার স্বামী ও সহযোগী ফয়সালকে নিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করতো। আর ইয়াবা বিক্রির টাকা গ্রহণ করতো দুই বিকাশ এজেন্ট এ আর জনি টেলিকম ও মরিয়ম টেলিকমের মাধ্যমে। সিআইডির কর্মকর্তারা তদন্তে রূপার ৫৬ লাখ টাকা গ্রহণের তথ্য-প্রমাণ পান। এ বছরের ৯ জানুয়ারি রূপার সহযোগী ফয়সাল ও জনি টেলিকমের আব্দুর রহিম জনি এবং ১৫ মার্চ মরিয়ম টেলিকমের আব্দুল কুদ্দুসকে গ্রেফতার করা হয়।
পাঠকের মতামত: