নিউজ ডেস্ক ::
দেশে মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার। কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন প্রায় দেড়শ’ ব্যক্তি৷ কিন্তু এখনো মাদকের কোনো গডফাদার বন্দুকযুদ্ধে নিহত, এমনকি আটক হয়েছে বলেও খবর পাওয়া যায়নি। কেন – জানতে চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে।
কক্সবাজারের টেকনাফে মৌলভীপাড়া ও জালিয়াপাড়া নামে দু’টি এলাকা আছে। ওই দু’টি এলাকায় ৭-৮ বছর আগেও কোনো পাকা বাড়ি পর্যন্ত ছিল না। কারণ, এলাকার কেউ দিনমজুর, কেউ জেলে আবার কেউবা পরিবহণ শ্রমিক। পাকা বাড়ি তারা বানাবে কিভাবে? কিন্তু এখন? এখন সেখানে তাক লাগানোর মত কয়েক শ’ বিলাসবহুল বাড়ি। কিভাবে সম্ভব ? অভিযোগ আছে, ইয়াবা ব্যবসা করে।
সাম্প্রতিক মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর ওই দুই এলাকা বলতে গেলে পুরুষশূন্য। আবার কোনো বাড়ি পুরোপুরি তালাবদ্ধ। টেকনাফ পুলিশ শুক্র ও শনিবার দুই দফায় ওই এলাকায় অভিযান চালিয়েছে, কিন্তু কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে পায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, মাদক ব্যবসায়ীরা তো বছরের পর বছর মাদক ব্যবসা করে আসছে, তাহলে পুলিশ তাদের আগে কেন গ্রেপ্তার বা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেনি?
‘তারা বাড়ি থাকেনা তাই আটক করতে পারিনি’
এই প্রশ্নের জবাবে টেকনাফ থানার ওসি রনজিত কুমার বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এর আগেও আমরা অভিযান চালিয়েছি। তবে তারা বাড়ি থাকে না, তাই আটক করতে পারিনি৷ এখন তারা বাড়িতে তালা মেরে পালিয়েছে৷ তাদের বাড়িগুলো রাজপ্রাসাদের মতো।
তিনি বলেন, ওই দু’টি এলাকা সীমান্তবর্তী। তাই মাদক ও ইয়াবা পাচারের বড় রুট। আপাতত ওই রুট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি আর বেশ কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক ও ইয়াবা উদ্ধার করেছি।
দেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে যারা মাদক ব্যবসায়ী বলে পরিচিত, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাদের আটক করা হচ্ছে, তারা মাদকসেবী ও সাধারণ খুচরা বিক্রেতা।
যারা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বা মূল পাচারকারী তারা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। তাদের কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে, আবার কেউ রাজনৈকিতভাবে প্রভাশালী হওয়ায় এলাকাতেই আছে। আর মাদক আইনের ফাঁকের কারণে তাদের ধরাও যাচ্ছে না বলে পুলিশ জানায়।
বাংলাদেশে মাদকের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে। তাদের একাংশ মাদক চোরাচালান করেই এখন সিআইপি ব্যবসায়ী পর্যন্ত বনে গেছে।
এ রকম ১৪১ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকাও করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারা ধরা পড়ছে না। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার তৎপরতা ছাড়াও আইনের ফাঁকফোঁকর কাজ করছে বলে অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকলেও কারোর দখলে বা অবস্থানে মাদক পাওয়া না গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বা গডফাদার তারা মাদক পরিবহণ করে না বা নিজেদের কাছে রাখে না। ফলে তারা মূল অপরাধী হলেও পার পেয়ে যায়।
যারা মাদক খুচরা বিক্রয় বা সেবন করে তারাই ধরা পড়ে। আর আইনে মাদক সেবনকারী, বিক্রেতা, পাচারকারী ও নিয়ন্ত্রক আলাদাভাবে নেই। ফলে যার কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, কেবল তাকেই মামলায় আসামি করা হয়।
আইনের এই দুর্বলতার কারণে মাদক মামলায় শাস্তিও হয় খুব কম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, এই আইনে ২০১৭ সালে সারাদেশে মোট মামলা হয়েছে এক লাখেরও বেশি। কিন্তু এর মাত্র আড়াই হাজার মামলা আদালতে নিস্পত্তি হয়েছে। আর এসব মামলায়ও ২,৬৮০ জন আসামির বেশিরভাগই খালাস পেয়ে গেছে।
‘তারা নিজেদের কাছে মাদকদ্রব্য রাখেন না’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, মাদকসহ হাতেনাতে ধরতে না পারলে তাকে আইনের আওতায় আনা যায় না। ফলে গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। কারণ তারা তো নিজেদের কাছে মাদকদ্রব্য রাখে না। আমরা তাদের সম্পর্কে তথ্য পেলেও মাদক আইনে কিছু করতে পারি না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, তারা মাদকের গডফাদারদের একটি তালিকা করে দুদকে দিয়েছে। তাদের সাধারণ মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে ধরা যাচ্ছে না, তাই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে মানিলন্ডারিং আইনে যাতে মামলা করা যায়। দুদক ওই তালিকা ধরে কাজও শুরু করেছে বলে জানা যায়।
পাঠকের মতামত: