ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

মাতৃভাষায় লেখাপড়া শিখছে রোহিঙ্গা শিশুরা

কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুরা লেখাপড়া শিখছে মাতৃভাষায়। প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ‘শিশুবান্ধব’ পাঠশালা। বাংলাদেশের মাটিতে এ পাঠশালা চালু হলেও বাংলা ভাষায় কোন বিষয় পড়ানো হয় না। সেখানে তাদের বার্মিজ, ইংরেজী ও অংক শেখানো হচ্ছে। নতুন-পুরাতন সব শিশুই পাচ্ছে এ শিক্ষার সুযোগ।
শিক্ষকরা জানান, কোন না কোন সময় রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরে যাবেÑএমন আশায় তারা মিয়ানমারের জাতীয় ভাষা বার্মিজ ভাষায় লেখাপড়া করাচ্ছেন রোহিঙ্গা শিশুদের।
উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে ‘মায়ার বাঁধন-১’ নামে একটি পাঠশালায় ঢুকতেই নজর কাড়ে ভেতরের নান্দনিক পরিবেশ। চারপাশের বাঁশের বেড়ার দেওয়ালে রোহিঙ্গা শিশুদের হাতে আঁকা নানা ধরনের ছবি। ফুল, পাখি, গাছ, নদী, পাহাড়, প্রকৃতি সবই আছে এসব ছবিতে। মাথার উপরে ঝুলছে বার্মিজ ও ইংরেজী বর্ণমালা, ঘুড়ি ও ফুল-পাখির ছবি। নিচে পুরো বেড়ার দেওয়াল ঢেকে আছে বার্মিজ ও ইংরেজী ছড়া এবং বর্ণমালার ফ্লিপ চার্ট, মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ফল, মাছ, পাখি ও প্রাণীর পরিচিতি সম্বলিত ফ্লিপচার্ট। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থার (ইউনিসেফ) সহযোগীতায় এই ‘শিশুবান্ধব’ পাঠশালা তৈরী করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘মুক্তি’।
পাঠশালার ভেতরে ব্যাপক আনন্ধঘন পরিবেশ চোখে পড়ে। অনেকটা গানের সুরে ইংরেজী ছড়া ‘রেইন রেইন গো এওয়ে’ পাঠ করছে শিশুরা। সকলের মুখে হাসি। শিক্ষার্থীরা সকলে বসেছে ইউ আকৃতিতে। শিক্ষক আলেয়া বেগম তাদের পড়াচ্ছেন। সেখানে পড়ার ফাঁকে কথা হয় দুই ভাই-বোন মো: রিয়াজ ও শাহিদার সাথে। রিয়াজের বয়স সাড়ে ৯। শাহিদার ৮। দু’জনেই গ্রেড ওয়ানের শিক্ষার্থী।
কথা প্রসঙ্গে মো: রিয়াজ জানায়, এই পাঠশালায় পড়তে তার খুব ভাল লাগে। এরকম পাঠশালা তার দেশ মিয়ানমারে নেই। এখানে শিক্ষকরা তাদের খুব ¯েœহ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলতে দেন, মাঝে-মাঝে গল্প শোনান। ছবিও আকঁতে দেন। ছবি আকঁতে সে খুব আনন্দ পায়। এই পাঠশালার পরিবেশ খুব ঠান্ডা। অথচ শিবিরে ত্রিপলের ছাউনি হওয়ায় তাদের ঘরে প্রচন্ড গরম। তাই ঘরের চেয়ে পাঠশালায় সময় কাটাতেই তার ভাল লাগে।
শাহিদা জানায়, শিক্ষকরা এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি কিভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধোয়া, নিয়মিত দাঁত মাজা, নখ পরিস্কার করাÑএসব বিষয়ও শিখেছে। সে পড়তে, ছবি আঁকতে এবং খেলতে ভালবাসে।
এ পাঠশালায় আলেয়া ছাড়াও আরেকজন শিক্ষক রয়েছেন। তার নাম আলম শাহ। তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর সাহেব বাজার এলাকায়। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা এ যুবক শিশুদের বার্মিজ ভাষায় পড়ান। আলেয়া পড়ান ইংরেজী ও অংক। আলেয়ার বাড়ি উখিয়ার রতœাপালং ইউনিয়নে।
পাঠদানের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক আলেয়া বেগম বলেন, ‘এখানে শিশুরা খুব আনন্দের সাথে সময় কাটায়। আমরা তাদের সবসময় হাসিখুশি পরিবেশে পড়ানোর চেষ্টা করি। তারা এসেম্বলি ও ব্যায়াম করে। গান গায়, গল্প বলে, ছবি আঁকে। সবই হয় বার্মিজ ও ইংরেজী ভাষায়। এসব সৃজনশীল কাজের পাশাপাশি আমরা তাদের স্থাস্থ্যের বিষয়েও সচেতন করি। প্রতিদিন প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির পক্ষ থেকে এক প্যাকেট করে বিস্কুট দেওয়া হয়।’
তিনি আরও জানান, এখানে তিন শিফটে শিশুদের পড়ানো হয়। প্রথম শিফ্টে ‘আর্লি লার্নিং’ (প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা) শ্রেণীতে পড়ে ৪ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুরা। দ্বিতীয় শিফ্টে গ্রেড ওয়ান শ্রেনীতে পড়ে ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা। তৃতীয় শিফ্টে গ্রেড ওয়ান শ্রেণীতে পড়ে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরা।
কুতুপালংয়ে মুক্তি কর্তৃক আরও তিনটি পাঠশালা ঘুরে প্রায় একই চিত্র চোখে পড়ে। পাঠশালাগুলো হলো, সানরাইজ চাইল্ড লার্নিং সেন্টার-১, সানরাইজ চাইল্ড লার্নিং সেন্টার-২ এবং পাহাড়িকা চাইল্ড লার্নিং সেন্টার।
সানরাইজ চাইল্ড লার্নিং সেন্টার-১ এর শিক্ষার্থী সুমাইয়া বিবির বয়স ১০। সে গ্রেড ওয়ানের শিক্ষার্থী। সুমাইয়া জানায়, এই পাঠশালায় ভর্তি হয়ে সে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত গুনতে শিখেছে। ৬টি বার্মিজ ছড়া ও ৬টি ইংরেজী ছড়া শিখেছে। এখানে পড়তে তার খুব ভাল লাগে।
মুক্তির ‘আরলি লার্নিং এন্ড নন ফরমাল বেসিক এডুকেশন প্রোগ্রাম ফর দি চিলড্রেন অব ফোর্সিবলি ডিসপ্লেস্ড মিয়ানমার ন্যাশনাল’ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী শান্তনু শেখর রায় বলেন, ‘জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থার (ইউনিসেফ) সহযোগীতায় উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে ১১৭ টি ‘শিশুবান্ধব’ পাঠশালা তৈরী করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘মুক্তি’। আরও ৩৩ টি পাঠশালা তৈরী করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। এই ১৫০ টি পাঠশালায় রোহিঙ্গা শিশুদের পড়াচ্ছেন ‘মুক্তি’র নিয়োজিত ৩০০ জন শিক্ষক। এ শিক্ষকদের মধ্যে ১৫০ জনই মিয়ানমারের নাগরিক। তারা শিশুদের বার্মিজ ভাষায় পড়ান। বাংলাদেশি শিক্ষকরা পড়ান ইংরেজী ও অংক।’
মুক্তির পয়েন্ট পার্সন (শিক্ষা) শওকত আলী বলেন, ‘প্রথম দিকে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য গড়ে তোলা শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর অবকাঠামোতে কিছুটা স্থায়ী রূপ ছিল। সেমিপাকা ঘর। সর্বশেষ সরকারের নির্দেশনা এবং সাহায্য সংস্থার ডিজাইন অনুসারে বাঁশ দিয়ে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর সম্পূর্ণ অবকাঠামো তৈরী করা হয়েছে। উপরে ছনের ছাউনি। যাতে ভেতরের পরিবেশটা ঠান্ডা থাকে এবং শিশু শিক্ষার্থীরা স্বস্তি পায়।’
বেসরকারি সংস্থার মুক্তির প্রধান নির্বাহী বিমল চন্দ্র দে সরকার বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা হলো, ভিন দেশে আশ্রয় নিয়েও স্বদেশের প্রতি মমত্ববোধ আর ভাষার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠবে রোহিঙ্গা শিশুরা। তাদের জাতীয় ভাষা যেহেতু বার্মিজÑতাই তাদের বার্মিজ ভাষাতেই পড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি ইংরেজীও শেখানো হচ্ছে। আমরা তাদের জন্য শতভাগ শিশুবান্ধব শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছি।’

পাঠকের মতামত: