ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরের উরিতে একটি ব্রিগেড সেনা দফতরে হামলায় ১৭ জওয়ান নিহতের পর থেকে পাকিস্তান-ভারত নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে যতোটা না উত্তেজনা বিরাজ করছে তার চেয়ে বেশি আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে উভয় দেশের সংবাদমাধ্যম। শুধু উভয় দেশ নয়, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে একাধিক খবর প্রকাশিত হয়েছে। একদিকে দুই দেশের নেতারা যেমন বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন তেমনি উভয় দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে ওঠেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বাংলা সংস্করণ উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলার পর ভারত কর্তৃক পাকিস্তানে হামলার বিষয়ে অন্তত তিনটি খবর প্রকাশ করেছে। খবরগুলোর শিরোনাম হচ্ছে,‘ভারতের মোকাবেলায় কতটা তৈরি পাকিস্তান’, ‘কতটা প্রস্তুত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী?’ এবং ‘ভারতকে ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সব কিছু করবে পাকিস্তান’।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মিরের উরিতে হামলার পটভূমিতে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তার মধ্যে পাকিস্তানের সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন ভারত, সীমান্ত পেরিয়ে সীমিত আকারে একটি সামরিক তৎপরতা চালাতে পারে – তাই কিছুটা হলেও একটা আশঙ্কা পাকিস্তানে তৈরি রয়েছে।
ইসলামাবাদে নিরাপত্তা এবং সামরিক বিশ্লেষক ড: আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘তবে সেরকম পরিস্থিতির জন্য ভারত এবং পাকিস্তান – কোনও দেশেরই কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। একবার যদি এ ধরণের যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কীভাবে তা বন্ধ করা যাবে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যাবে – তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যেই উদ্বেগ রয়েছে।’
উরিতে হামলার পর ভারত এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানে হামলা চালাতে পারে, এমন জল্পনা চলছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে। এরকম আশংকা থেকে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ দেশটির উত্তরাঞ্চলের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
কাশ্মিরের সেনা ঘাঁটিতে হামলার জন্য ভারত দায়ী করছে পাকিস্তানকে, আর পাকিস্তান পাল্টা অভিযোগ করছে কাশ্মিরে তীব্র সহিংস গণবিক্ষোভ থেকে দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করছে ভারত।
ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বে একটা বড় অংশ গত কয়েকদিন ক্রমাগত বলছেন, পাকিস্তানকে একটা শিক্ষা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আর তা ফলাও করে ভারতের প্রায় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ড. আয়েশা সিদ্দিকার মতে, পাকিস্তানের ভেতর একটা চিন্তা কাজ করছে যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা যেখানে রয়েছে, সেখানে ভারত, পাকিস্তানের ভেতর দুঃসাহসিক কোনও অভিযানের আগে দশবার চিন্তা করবে।
সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর অনুসারে, ভারত যদি সীমিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা হবে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি। দু-তিনটি সম্ভাব্য টার্গেট হয়ত ভারতের থাকবে। কাশ্মিরে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি জায়গাগুলোতে কোনও জঙ্গি শিবির আছে কিনা সেটা ভারত খুঁজে ধ্বংস করতে চাইবে। এছাড়া লস্কর-ই-তইবা’র বেশ কিছু সদর দপ্তর হয়তো সম্ভাব্য টার্গেট হতে পারে। তবে এগুলোর সবগুলোই ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায়। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোর জানাচ্ছে, ভারতীয় হামলা ঠেকাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।
পাকিস্তানে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে যে ভারতের সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ক্রমশই সরে আসছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের সঙ্গে আলাপ করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে এ নিয়ে বেশ সতর্ক অবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা পিআইএ’র একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, সকাল থেকে গিলগিট, স্কার্দু ও চিত্রাল এলাকায় ‘বিমান পথ বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ’।ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে পারে এমন আশংকায় এসব ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসলামাবাদ ও পেশোয়ারের মধ্যকার মূল মহাসড়কের কিছু অংশও বন্ধ রাখা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সংস্কারের জন্য মহাসড়ক বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এই মহাসড়ক যুদ্ধবিমানের ওঠানামায় ব্যবহার করা সম্ভব।
শুক্রবার রাশিয়ার সেনাবাহিনীর একটি দল যৌথ মহড়ার জন্য পাকিস্তানে পৌঁছেছে। এতে করে চলমান উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, ভারতকে সতর্ক করতেই এই মহড়া। বিপরীতে ভারতও শুক্রবার ঘোষণা দিয়েছে, দেশটি ফ্রান্সের কাছ থেকে ৩৬টি যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে। চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জি-নিউজের একটি খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিমানবাহিনী হয়ত ভারতে হামলার লক্ষ্য বস্তু চিহ্নিত করেছে। যে কোনও সময় হামলা চালাতে পারে। জি-নিউজের আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, উরিতে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ভারত ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ইন্দুস পানি চুক্তি পুনরায় বিবেচনা করতে পারে।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মন্তব্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তান হয়ত পারমাণবিক যুদ্ধ জড়িয়ে পড়তে পারে। এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম দৈনিক পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনেও।
হামলার পরপরই পাকিস্তানকে একটা সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ভারতের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় বলে আনন্দবাজারসহ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষক রাহুল বেদি জানান, ভারতের নিরাপত্তা নীতির সাথে জড়িতদের একটি অংশ বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানকে একটি শিক্ষা দেওয়া, বার্তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা মনে করেন, পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকলেও স্বল্প মাত্রার ঝটিকা একটি সামরিক অভিযান সম্ভব। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা লে জে বিজয় কাপুর বলেন, ‘পাকিস্তানকে এখনই দেখাতে হবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কতোটা।’ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোবালও এই মতের পক্ষে। আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্তমান কমান্ডের একাংশ মনে করেন, সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আস্তানায় স্পেশাল ফোর্স দিয়ে হামলা করা সম্ভব। সম্প্রতি মিয়ানমারের ভেতরে নাগা বিদ্রোহীদের দুটো আস্তানায় সেরকম অভিযান চালানো হয়েছে।
একই সঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, মোদি সরকারের পক্ষে পাকিস্তানকে এই মুহূর্তে সামরিক পথে জবাব দেওয়া কার্যত অসম্ভব। সেনা কর্মকর্তারা সরকারের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জানিয়েছেন, দু’টি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে কখনওই ‘নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ’ করা সম্ভব নয়। তা দ্রুত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হবে এবং আন্তর্জাতিক মহলও তা মেনে নেবে না। এমনকী নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরে ঢুকে জঙ্গি শিবির গুঁড়িয়ে দিতে হলে তার ফলাফল কী হতে পারে, তা-ও ভেবে দেখা দরকার বলে মত প্রকাশ করেছেন সেনা কর্মকর্তারা। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আপাতত কূটনৈতিক পথেই ইসলামাবাদকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে নয়াদিল্লি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ বলেছেন,‘আবেগতাড়িত হয়ে প্রত্যাঘাত করা হবে না। ঠাণ্ডা মাথায় অংক কষে জবাব দেওয়াটাই এখন জরুরি।’
সরাসরি যুদ্ধে বা কমান্ডো অভিযানে না গেলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর শক্তি বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। পাকিস্তানের দিক থেকে অস্ত্রবিরতি চুক্তি ভাঙা বা অনুপ্রবেশে মদত দেওয়ার ঘটনা ঘটলেই, জোরালো বে জবাব দিতে বলা হয়েছে।কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী বৃহস্পতিবার ভারী সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করা হয়েছে। কাশ্মির সীমান্তের ৭৭৮ কিলোমিটার এলাকায় কঠোর নজরদারি ও সেনা উপস্থিতি বৃদ্ধি করা হয়েছে।এর মধ্যে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করে ভারত।
সংবাদমাধ্যমগুলো ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলেও উভয় দেশের সরকার নিজেদের সতর্ক অবস্থানে রাখলেও মূলত কূটনীতির পথেই হাঁটছে। ভারত চাইছে হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার বিষয়টি বিশ্বের সামনে তুলে ধরে একঘরে করতে। বিপরীতে পাকিস্তান কাশ্মিরে ভারত কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছে। যাতে করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাশ্মির ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করে। ভারত চায় না কাশ্মির নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হস্তক্ষেপ করুক।
কাশ্মিরে হামলার পর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যেও অঞ্চলটিতে টানা বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। টানা ৭৫তম দিনের মতো কাশ্মির অচল হয়ে রয়েছে। বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কাশ্মিরে আরও ৬৪ জন তরুণকে গ্রেফতার করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপক বিক্ষোভের শুরু হয় কমান্ডার বুরহান ওয়ানিসহ তিন হিজবুল যোদ্ধা নিহত হওয়ার পর। ৮ জুলাই কাশ্মিরের অনন্তনাগের কোকেরনাগ এলাকায় সেনা ও পুলিশের বিশেষ বাহিনীর যৌথ অভিযানে তারা নিহত হন। এর পর কাশ্মিরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ কাশ্মিরিদের দাবি, বুরহানকে ‘ভুয়া এনকাউন্টারে’ হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে পুলওয়ামা ও শ্রীনগরের কিছু অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়। পরবর্তীতে বিক্ষোভের মাত্রা বেড়ে গেলে কাশ্মিরের দশটি জেলা, এমনকি দূরবর্তী গ্রামেও কারফিউ জারি করা হয়। বিক্ষোভ দেখিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন মানুষ। আর বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা জারি রাখে নিরাপত্তা বাহিনী। আর তাতে প্রাণ হারায় অন্তত ৬৭ জন। টানা ৫২ দিন পর ২৯ আগস্ট শ্রীনগরের কয়েকটি এলাকা থেকে কারফিউ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও ১৪৪ ধারা জারি থাকে।
উল্লেখ্য, ১৮ সেপ্টেম্বর (রবিবার) ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ভারি অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একদল লোক কাশ্মিরের উরিতে লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে সামরিক বাহিনীর একটি প্রশাসনিক স্থাপনায় হামলায় চালায়। ওই হামলায় ১৭ সেনা সদস্য ও ৪ হামলাকারী নিহত হন। এখন পর্যন্ত কোনও সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই হামলার দায় স্বীকার করা হয়নি। তবে হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জয়েশ-ই-মোহাম্মদকেই সন্দেহ করছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এর আগে চলতি বছরের প্রথমদিকে পাঞ্জাবের পাঠানপকোটে ভারতের বিমানঘাঁটিতে হামলার জন্যও ওই সশস্ত্র সংগঠনটিকে দায়ী করেছিল ভারত। জঙ্গি এ সংগঠন পাকিস্তানের সৃষ্টি এবং পাকিস্তানে থেকেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে বলে ভারত দাবি করে আসছে। সূত্র: এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, আনন্দবাজার, নিউ ইয়র্ক টাইমস, জিও নিউজ, ডন, জি-নিউজ, বিবিসি বাংলা, টাইমস অব ইন্ডিয়া।
পাঠকের মতামত: