:: জিয়া হাবীব আহসান, এডভোকেট ::
সকল আইনজীবী ‚এডভোকেট” নন, কিন্তু সকল এডভোকেট ‚আইনজীবী”। বিষয়টা বুঝার সুবিধার্থে -এ- আলোচনার অবতারণা । যেমনঃ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল তালিকাভুক্ত না হলে কোন ব্যারিস্টার মহোদয়কেও ‚এডভোকেট” বলা যাবে না। তেমনি ‚কর আইনজীবী”, ‚শিক্ষানবিশ আইনজীবী”, ‚আইনজীবী সহকারী” প্রমুখ ‚এডভোকেট” নহেন ।
‚এডভোকেট” শব্দটি বাংলা অনুবাদ ‚আইনজীবী” নয়, এর বাংলা ইংরেজি দু’টাই ‚এডভোকেট” (Advocate) । যা আমাদের বার কাউন্সিল এ্যাক্টও এডভোকেট উল্লেখ আছে ।
আমাদের ‚Advocate”, ‚advocateship”, ‚advocacy” প্রভৃতি শব্দ লিখার আর বলার পুন:অভ্যাংস করা উচিৎ। কারণ আমাদের সংবিধানে বা বার কাউন্সিল এ্যক্টের কোথাও ‚আইনজীবী” বা ‚উকিল” শব্দ লিখা নেই। ‚Advocate” শব্দ লিখা, যা বাংলায়ও ‚এডভোকেট” হিসেবে বাংলা ভাষায়ও প্রতিষ্ঠিত শব্দ। শব্দটি আন্তর্জাতিক ভাবেও সুপরিচিত।
আইনবিদ” শুনতেও অনেক ভালো লাগে, এটার মধ্যে Aristocracy বিদ্যমান। জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট, ১৮৯৭-এর ধারা ৩(২এ) ’ ‚এডভোকেট” শব্দের সংজ্ঞা করেছে এ রকম, ‚অ্যাডভোকেট”’ হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ‚বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২”’ অনুসারে তালিকাভুক্ত।
সে ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের অর্ডার (রাষ্ট্রপতির আদেশ)-এর ২(এ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‚অ্যাডভোকেট”’ হচ্ছেন একজন ‚অ্যাডভোকেট”, যিনি অত্র আদেশের বিধান অনুসারে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এখানে তালিকা (roll) বলতে বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ও ব্যবস্থাপনাকৃত অ্যাডভোকেটবৃন্দের তালিকাকে বোঝায়।
অ্যাডভোকেট” হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে গেলে একজন ব্যক্তির কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে এবং তাঁকে কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে; সে সম্পর্কে বিধান রাখা আছে পূর্বোক্ত ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশে এবং সেই আদেশের বলে একই সালে প্রণীত বিধিমালায়।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, আইন পেশা অনুশীলন (practice) করার অনুমোদন কেবল একজন অ্যাডভোকেটকে দেওয়া হয়েছে এবং একজন ‚অ্যাডভোকেটই” আদালতে আইন প্র্যাকটিস করার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত [পড়ুন পূর্বোক্ত রাষ্ট্রপতির আদেশের ১৯ ও ৪১ অনুচ্ছেদ দুটি]। ইংরেজি ‚Advocate”’ শব্দের বাংলা হিসেবে বর্তমানে ‚আইনজীবী”’ বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ।
কদাচিৎ ‚উকিল”’ বা ‚কৌঁসুলি”’ শব্দের ব্যবহার এখনো দেখা গেলেও, ১৯৮৫ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রণীত হওয়ার পর থেকে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে, বিভিন্ন আইন, নীতিমালা, সরকারি দলিলাদি, মামলার রায় ও বিচার বিভাগীয় আদেশ-বিজ্ঞপ্তি কিংবা বার কাউন্সিল এবং বার অ্যাসোসিয়েশনসমূহের দাপ্তরিক (official) দলিলাদিতে বাংলায় অ্যাডভোকেট সম্পর্কে লিখতে গেলে ‚আইনজীবী”’ শব্দেরই ব্যবহার হচ্ছে।
আইনজীবী” শব্দটি পেশাগত পরিচয় হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইনে নেই; কিছুকাল আগে চালু হওয়া সুচিন্তাহীনভাবে মনগড়া অসম্মানজনক আখ্যান এ’টি। ‚Advocate” এর শাব্দিক অর্থ ‚প্রবক্তা”। জীবিকা নির্ভর/নির্দেশক ‚জীবি” শব্দাংশটি শ্রুতিমধুর নয়। ইমেইজ-মধুরতো নয়ই বরঞ্চ শ্রুতিকটু, ইমেইজ অবনমনমূলক ও বটে।
ইংরেজি ‚Advocate ” শব্দটি ‚এডভোকেট” হিসেবেই বাংলা ভাষার অংগীভূত হয়ে গেছে প্রায়। আচ্ছা, পেশা পরিচয়ের জন্যব খাঁটি বাংলা শব্দেরই যদি প্রয়োজন হয় তা’হলে ‚আইনবিদ” শব্দটি কেমন হয়? সম্মানজনক ও শ্রুতিমধুর, নয় কি ?তা’ছাড়া আদালতে শুনানিতে/বিচার প্রক্রিয়ায় ‚learned counsel” এর বাংলা হিসেবে “বিজ্ঞ কৌশুলী” সুদীর্ঘদিন ব্যদবহৃত, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত শব্দ।
অন্ততঃ এই যথার্থ এবং সুন্দর আখ্যাজটির যেন আমরা অবনমন (বিজ্ঞ আইনজীবী) না ঘটাই। আইন পেশায় সম্বোধন বিতর্ক ও অপব্যবহার নিয়ে আইনবিষয়ক গবেষক জনাব আহমদ মুসাননা চৌধুরীর বক্তব্য চমৎকার প্রণিধানযোগ্য। এ প্রসঙ্গে তাঁর আলোচনা ও ব্যাখ্যা খুবই প্রসঙ্গিক ।
তিনি বলেন, ‚অ্যাডভোকেট”, ‚লইয়ার” এবং ‚আইনজীবী” এই সম্বোধন তিনটিকে পৃথক করে দেখলে প্রতারণার ক্ষেত্র তৈরি হয়। ‚অ্যাডভোকেট”, ‚লইয়ার” এবং ‚আইনজীবী” এই সম্বোধন তিনটিকে পৃথক করে দেখলে প্রতারণার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনের আচার হচ্ছে, একজন ‚অ্যাডভোকেটকে” ‚বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট”’ Learned Advocate বলে সম্বোধন করা। এটি প্রথাগত সম্মানসূচক অভিধা। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, বিচক্ষণতা, বিচার-বিশ্লেষণী ক্ষমতা, পেশাদারত্ব, দায়িত্ববোধ, সততা, পরিচ্ছন্ন আচরণ-ভূষণ দ্বারা নিজ পেশার মর্যাদা উজ্জ্বল করবেন এমনই প্রত্যাশা একজন ‚অ্যাডভোকেটকে” নিয়ে।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়, সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলে, দেশের কল্যাণমুখী রাজনীতিতে অ্যাডভোকেটদের সক্রিয় প্রতিনিধিত্ব থাকবে, এটি স্বাভাবিক চিন্তা। বাংলাদেশে আইন পেশার সঙ্গে ‚অ্যাডভোকেট”’ শব্দের সম্বন্ধ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু বিতর্ক কিংবা বলা চলে, অস্পষ্টতা তৈরি করা হয়েছে ইংরেজি ‚lawyer”’ আর বাংলা ‚আইনজীবী”’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে।
ইংরেজি ‚lawyer”’ (লইয়ার) শব্দের অর্থ ব্যাপক। দেশি–বিদেশি বিভিন্ন অভিধানে সাধারণত লইয়ার’ শব্দের মানে করা হয়, একজন ব্যক্তি যিনি আইন অনুশীলন করেন, ‚আইনের পরামর্শদাতা”, ‚আইনজ্ঞ”, ‚অ্যাডভোকেট”, ‚আইনজীবী”, ‚উকিল”, ‚লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার”, ‚ব্যারিস্টার (barrister)”, ‚সলিসিটর (solicitor)”, ‚অ্যাটর্নি (attorney)”, ‚প্লিডার (pleader)”, ‚কাউন্সেল (counsel)”, ‚প্রসিকিউটর (prosecutor)”, ‚মোক্তার”, ‚আইনের ডিগ্রি অর্জনকারী” ইত্যাদি।
শব্দার্থের ব্যাপকতা বিবেচনায় মূলত বিদেশি অভিধানের বরাত দিয়ে, অনেকে যুক্তি দেখিয়ে বলে থাকেন, সকল ‚অ্যাডভোকেট” ‚লইয়ার” কিন্তু সকল লইয়ার ‚অ্যাডভোকেট” নন।
আবার অনেকে আছেন যাঁরা ‚আইনজীবী”’ শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই একই ধারণা উপস্থাপন করতে চান। তাঁদের মতে, একজন ব্যক্তি আইনবিষয়ক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেই তাঁকে ‚আইনজীবী” বলা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উভয় সম্বোধন নিয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতীতি সঠিক নয়।
ইদানীং দেশে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন আইন কলেজ, সরকারি কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই বা চার বছরের এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করা মাত্রই অনেকে নিজেকে ‚লইয়ার” কিংবা ‚আইনজীবী” পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। এঁরা হয়তো আইন পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু তারা সবাই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত ‚অ্যাডভোকেট” নন।
অ্যাডভোকেট” হয়ে ওঠেননি, অথচ ‚আইনজীবী” অথবা ‚লইয়ার” শব্দ দুটির একটিকে জুড়ে দিয়ে ট্যাক্স/ইনকাম-ট্যাক্স ‚আইনজীবী”’ (Tax/Income-tax Lawyer), ‚ভ্যাট আইনজীবী” (VAT Lawyer), ‚শিক্ষানবিশ আইনজীবী” (Apprentice Lawyer), ‚অ্যাপ্রেনটিস/প্র্যাকটিসিং লইয়ার অ্যাট জজকোর্ট”, এরূপ পরিচয় ধারণ করছেন এমন লোকের সংখ্যা এখন ভূরি ভূরি।
আবার কোনো কোনো ‚অ্যাডভোকেট” আছেন, যাঁরা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিস অনুমতি সংক্রান্ত আবেদন বার কাউন্সিলে জমা দিয়েই প্র্যাকটিসিং/অ্যাপ্রেনটিস লইয়ার/ব্যারিস্টার অ্যাট সুপ্রিম কোর্ট হিসেবে নিজের পরিচয় প্রচার করেন।
উক্ত ব্যক্তিদের এমন পরিচয় প্রদানের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই; আদালত থেকে শুরু করে আইনাঙ্গন তাঁদের এই পরিচয়কে স্বীকৃতি দেয় না। যাঁদের আইন বিষয়ে কোনো ডিগ্রি নেই, কিন্তু নিজেকে আইনজীবী, লইয়ার এমনকি অ্যাডভোকেট পরিচয় দিয়ে লোক ঠকিয়ে উপার্জন করে থাকেন। এঁরা প্রতারক।
এসব লোক যখন আইন পেশা সংক্রান্ত কাজ বা মামলা ভাগিয়ে নিয়ে অর্থের বিনিময়ে একজন ‚অ্যাডভোকেটের” হাতে তুলে দেন বা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন, তখন তাঁদের আলাদাভাবে আমরা চিহ্নিত করি টাউট’ হিসেবে। টাউট প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট টাউট আইন দেশে রয়েছে। উল্লেখ্য, টাউটরা এই লেখার উপলক্ষ নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের এখানে আইন পেশার একই মানে ছিল না।
ভূমিকাও এক ছিল না। আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা এক শব্দে পরিচিত হতেন না, এখনো হন না। আইন পেশায় নিয়োজিতরা কালপ্রবাহে কী নামে পরিচয় পাবেন বা পরিচিত হয়ে থাকেন, তা সমকালীনতা রেওয়াজ। এর পাশাপাশি দেশ ও সমাজের ইতিহাস, সংশ্লিষ্টদের আচার-দৃষ্টিভঙ্গি, আদালতি নজির (precedence), আইনকানুন অনুশীলনের ঐতিহ্য এবং গতিবিধির অন্তর্গত চর্চা ও তর্কবিতর্ক বিচার করে বুঝতে হবে।
সে অনুসারে বর্তমান বাংলাদেশে ‚অ্যাডভোকেট”, ‚লইয়ার” এবং ‚আইনজীবী” এই তিনটি সমার্থক শব্দ। আর এই শব্দত্রয় আইন পেশার অন্তর্ভুক্ত লোকদের নির্দেশ করে। যাঁরা হলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত একেকজন ‚অ্যাডভোকেট”।
বাংলাদেশে একজন ‚অ্যাডভোকেট” মূলত কে, সংক্ষেপে তা জেনে নেওয়া দরকার । আবার ‚অ্যাডভোকেট” শব্দের সমার্থক হিসেবে ‚লইয়ার” শব্দের ব্যবহার একটি প্রাত্যহিক ব্যাপার। বাংলাদেশের আইনসমূহ এবং আদালতের বিভিন্ন রায় ও আদেশসমূহ দেখলেই এই বক্তব্যের সমর্থন মিলবে।
লইয়ার’ শব্দের অর্থের ব্যাপকতা থাকলেও ‚অ্যাডভোকেট” না হলে এ দেশের আইন চর্চা ও প্রথা (custom) কোনো ব্যক্তিকে লইয়ার’ পরিচয় দেওয়ার অনুমোদন দেয় না। আমাদের দেশে আজও ‚অ্যাডভোকেট” নন এমন কোনো ব্যক্তি লইয়ার’ সম্বোধিত হয়েছেন বলে জানা যায় না। একই কথা ‚আইনজীবী” শব্দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অ্যাডভোকেট”, ‚লইয়ার” এবং ‚আইনজীবী”এই সম্বোধন তিনটিকে পৃথক করে দেখলে প্রতারণার ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিচারপ্রার্থীরা বিভ্রান্তিতে পড়েন। অ্যাডভোকেট না হয়ে ‚আইনজীবী” কিংবা লইয়ার শব্দ জুড়ে দিয়ে কারও পদবি গ্রহণ ও পরিচয় প্রচার আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে শুদ্ধ নয়।
ইঙ্গিতবাহী পরিভাষা ব্যবহার করে ‚অ্যাডভোকেট” ভান (pretend) করা অনুচিত ও বেআইনি কর্ম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধও। সদ্বিচার নিশ্চিতকল্পে ‚অ্যাডভোকেট” পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকা এজাতীয় সব শব্দের যত্রতত্র এবং কপটতাপূর্ণ ব্যবহার ও প্রচার বন্ধে অংশীজনদের সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে ——এডভকেটদের” নিয়ন্ত্রণকারী সর্বোচ্চ সংস্থা ——বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের” একটি সময়োপযোগী সিধান্ত সিধান্ত/সার্কুলারই যথেষ্ট, আইনজীবী সমিতি না লিখে ——এডভোকেট” বার এসোসিয়েশন, বার এসোসিয়েশন ভবন ইত্যাদি লিখা সমিচীন ।
লেখকঃ এড্ভোকেট, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী ।
পাঠকের মতামত: