ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

তিন লাখ টাকায়ও মন গলেনি ডিবি কর্মকর্তাদের!

dbরেজাউল করিমের কি অপরাধ তা জানেন না স্ত্রী পারভিন আক্তার। দুই মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার তার। হঠাৎ স্বামীর আটকের খবরে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে পারভিন আক্তারের।

২৮ মে গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ৯-১০ জন অপরিচিত ব্যক্তি তার স্বামী রেজাউল করিমকে আটক করে নিয়ে যান। একই সঙ্গে স্বামীর আয়ের উৎস – দুটি মিনি ট্রাকও নিয়ে যান তারা। তখন রেজাউল করিমের স্ত্রী পারভিন আক্তার বগুড়ায় তার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। স্বামীর এ খবর পেয়েই তিনি ঢাকায় ছুটে আসেন। কিন্তু কারা তার স্বামীকে আটক করেছেন তা জানতে কেটে যায় ৪ দিন।

স্বামীর সন্ধানে যখন গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন থানায় ঘুরে ফিরছিলেন, তখন (১ জুন) হঠাৎ একটি অপরিচিত মোবাইল ফোন নম্বর থেকে কল আসে পারভিন আক্তারের কাছে। ফোনে তাকে জানানো হয়, তার স্বামী ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে আছেন। তাকে ডিবি অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হয়। স্বামীর অবস্থান জানার পর কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন পারভিন আক্তার। ছুটে যান মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে।

শুক্রবার (২ জুন) বেলা ১১টার দিকে মিন্টো রোডে ডিবি অফিসের সামনে গিয়ে সেই মোবাইল ফোন নাম্বারে কল দেন পারভিন আক্তার। ফোন রিসিভ করে এক ব্যক্তি তাকে (পারভিন) ডিবি অফিসের সামনেই অপেক্ষা করতে বলেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি ডিবি অফিসের সামনে স্বামীর ওই ট্রাক দুটি দেখতে পান।

মঙ্গলবার ডিবি অফিসের সামনে ৫ বছর বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে অসহায়ের মতো বসে থাকতে দেখে কৌতূহলবশত পারভিন আক্তারের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তখন তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে উল্লিখিত সব তথ্য জানান।

পারভিন আরও জানান, ওইদিন (শুক্রবার) দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর দুপুরের দিকে এক ব্যক্তি ডিবির সদস্য পরিচয়ে তার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। পরে জানা যায়, ওই ডিবি সদস্যের নাম মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি (মোয়াজ্জেম) রেজাউল করিমের মুক্তি বাবদ তার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন বলে যুগান্তরের কাছে অভিযোগ করেন পারভিন। কিন্তু কি অপরাধে তার স্বামীকে আটক করা হয়েছে এবং গাড়ি দুটি নিয়ে আসা হয়েছে, সে প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি ডিবি’র ওই সদস্য।

পারভিন আরও জানান, শেষ পর্যন্ত রোববার মোয়াজ্জেম নামের ওই ডিবি সদস্যসহ আরও কয়েকজনের কাছে নগদ ৩ লাখ টাকা গুনে দেন পারভিন আক্তার। এ টাকা দেয়ার আগে তাকে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়া হয়। তখন গোয়েন্দা কার্যালয়ের সামনে ডিবির ওই সদস্যদের কাছে তিনি স্বামীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু নাছোড়বান্দা ডিবির ওই সদস্যরা বাকি দুই লাখ টাকা না হলে রেজাউল করিমকে ছাড়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

সর্বশেষ বুধবার পারভিন আক্তারের পরিবারের পক্ষ থেকে ডিবির ওই সদস্যদের জানিয়ে দেয়া হয়, বাকি টাকা দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত মুক্তি মেলেনি রেজাউল করিমের।

ঘটনাটির নেপথ্য কারণ খুঁজতে গত কয়েকদিন ধরে যুগান্তরের পক্ষ থেকেও অনুসন্ধান চালানো হয়। স্বামীকে ছাড়াতে ডিবি সদস্যদের সঙ্গে পারভিন আক্তার ও তার দেবর (রেজাউলের চাচাতো ভাই) নাজিরের দেন-দরবারের বেশকিছু স্থিরচিত্র এবং কথোপকথন রেকর্ড যুগান্তরের হাতে সংরক্ষিত রয়েছে। ওই কথোপকথন থেকে জানা যায়, ডিবি সদস্যরা তাদের ক্ষমতার কথা বলে আরও টাকা দাবি করছেন। আর টাকা না দিলে, তারা বড় মামলা দিয়ে রেজাউলকে কোর্টে পাঠাবে বলেও হুমকি দেন।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন। বুধবার সন্ধ্যায় তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি পরিচয় দিতে রাজি হননি।

একপর্যায়ে নিজেকে ডিবির কনস্টেবল পরিচয় দিয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দেন। ডিবির কত নম্বর টিমে আছেন, অথবা ওই টিমের প্রধান কে- তা জানতে চাইলে তিনি মাফ (ক্ষমা) চাইতে থাকেন। একপর্যায়ে যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কিছুই জানি না। এ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। রেজাউল নামে আমরা কোনো ব্যক্তিকে আটকও করিনি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডিবি সদস্য মোয়াজ্জেমের মোবাইল নম্বরটি এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। পরে তিনি ফোন করে বিষয়টি জানাবেন বলে সময় নেন। তবে বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত এ ব্যাপারে তিনি আর কোনো কিছু জানাননি।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ডিবি হেফাজতে থাকা রেজাউল করিমের স্বজনদের ভাষ্য মতে, গত ২৮ মে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থেকে ডিবি পরিচয়ে আটক করা হয় রেজাউল করিমকে। এ সময় তার মালিকানাধীন ঢাকা মেট্রো-ন ১৬৮৮১৫ এবং নম্বরবিহীন আরেকটি ট্রাক আটক করা হয়। এর পর থেকে চার দিন কোনো খোঁজ মেলেনি রেজাউলের। পরিবারের সদস্যরা তখনও জানেন না রেজাউল কোথায় আছেন। তার স্বজনরা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে ঘুরে রেজাউলের খোঁজ নেন বলে জানান তার স্ত্রী পারভিন আক্তার।

পারভিন আক্তার ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের সহায়তায় আমি আমার স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এরপর থেকেই ডিবি পুলিশের সদস্যরা দ্রুত টাকা দিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে নিতে বারবার চাপ দিতে থাকেন। পরে আমি গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা এনে গত রোববার পুলিশকে দিয়েছি। ডিবি ওই দিন জানায় ‘আগামী মঙ্গলবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আপনার স্বামীকে পাঁচশ’ টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হবে।’

পারভিন আরও জানান, পুলিশের দেয়া সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার ছিল পুলিশ হেফাজতে থাকা রেজাউল করিমকে মুক্তি দেয়ার দিন। সে মোতাবেক ওই দিন সকাল থেকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করেন পারভিন আক্তার ও রেজাউলের চাচাতো ভাই নাজির হোসেনসহ আরও দুইজন। ওই সময় ফোনে মোয়াজ্জেমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। তখন মোয়াজ্জেম তাদের জানান, ‘স্যার অপারেশনে রয়েছেন। তিনি না এলে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে না।’ একই দিন (মঙ্গলবার) বেলা দেড়টার দিকে মোয়াজ্জেম হোসেন পারভিন আক্তারের সঙ্গে দেখা করতে মিন্টো রোডের ডিবির মিডিয়া সেন্টারের সামনে আসেন। সেখানে তিনি বাকি দুই লাখ টাকা দেয়ার জন্য চাপ দেন।

ডিবির ওই কর্মকর্তা যখন পারভিন আক্তারের সঙ্গে টাকা নিয়ে দেনদরবার করছিলেন সেখানে যুগান্তরের এই প্রতিবেদকও উপস্থিত ছিলেন। ডিবির ওই কর্মকর্তা (মোয়াজ্জেম) গালাগাল দিয়ে পারভিন আক্তারকে বলেন, তিন লাখ টাকায় কি হয়। আরও দ্ইু লাখ টাকা না দিলে তোর স্বামীকে ছাড়া হবে না। এছাড়া গাড়ি উদ্ধার করতে হলে আরও এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে।’ ডিবির ওই কর্মকর্তা হুমকি দিয়ে আরও বলেন, পুলিশ ইচ্ছা করলে কলমের খোঁচায় আসামি খালাস দিতে পারে, আবার জেলেও পাঠাতে পারে। এ সময় ওই মহিলা কান্নাকাটি শুরু করেন।

ওই দিন (মঙ্গলবার) বেলা আড়াইটার দিকে ডিবির আরেক সদস্যকে দেখতে পেয়ে ছুটে যান পারভিন আক্তার। সেখানে বেশকিছু সময় ধরে তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। দূর থেকে প্রতিবেদক এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। ডিবির ওই সদস্যের সঙ্গে কি কথা হয়েছে তা জানতে চাইলে পারভিন আক্তার যুগান্তরকে বলেন, ‘টাকা নেয়ার সময় ওই অফিসারও ছিলেন। এ জন্য তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন কিছুক্ষণ পর বিষয়টি সমাধান করা হবে।’

রেজাউল করিমের চাচাতো ভাই নাজির হোসেন বুধবার যুগান্তরকে জানান, ‘আজ সকালে আমাদেরকে ফোন দিয়ে ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য বলেছে। আমরা বলেছি কোর্টে চালান দিতে। একপর্যায়ে ডিবির সদস্যরা বলেন নরমাল (দণ্ডবিধির সাধারণ ধারায়) মামলা দিয়ে দেব। আপনারা আসেন।’

নাজির আরও জানান, ‘২৮ মে বিকাল পাঁচটার দিকে রেজাউল ভাই কোনাবাড়ী গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে যান। এ সময় ডিবি পরিচয়ে গাড়িসহ তাকে আটক করা হয়। কি জন্য তাকে আটক করা হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।’সুত্র: যুগান্তর

পাঠকের মতামত: