ঢাকা,সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

‘সাদা পোশাকে গ্রেফতার ভয়াবহ অপরাধ’

image_155950_0নিজস্ব প্রতিবেদক :::

ঢাকা: সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা কাউকে গ্রেফতারের বিষয়টিকে ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা।

মঙ্গলবার ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা অনুযায়ী আটক ও রিমান্ডের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনার বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিলের শুনানি চলাকালে এ মন্তব্য করেন এসকে সিনহা।

আদালতে আপিল আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যদিকে রিটের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচরাপতি এসকে সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উদ্দেশে বলেন, ‘বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট রায়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। ১৩ বছর পার হয়ে গেলেও আপনারা (সরকার) একটি নির্দেশনাও প্রতিপালন করেননি।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি একটি কলোনিয়াল (ঔপনিবেশিক) আইন। ১৯৭০ সালে মালয়েশিয়া এ আইনের সংশোধনী এনেছে। মালয়েশিয়াকে অনুসরণ করে ভারতও তাদের ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছে। কিন্তু আমরা এখনো এটি করতে পারছি না।’

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো যথাযথ নয়। আর কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ হেফাজতে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমাদের দেশে আইন রয়েছে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, যথাযথ চিন্তাভাবনা না করেই আইন প্রণয়ন করার কারণে বিচার বিভাগের ওপর মামলার চাপ বাড়ছে।

তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আমাকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ডের দায়িত্ব পালনকারী এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আজও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার করেই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করছে, এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়ে আদালত যদি কোনো নির্দেশনা দেয়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আদালত আইন সংশোধনের জন্য এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে আদেশ দিতে পারেন না। আদালতকে সমন্বয় করতে হবে, যাতে করে মামলার আসামি এবং বাদী কেউই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘৫৪ ধারায় আসামিদের সুরক্ষার বিষয়ে নানা রকম বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু সমাজে নানা রকম মানুষ রয়েছে। আসামিদের যেভাবে অধিকার রয়েছে, তেমনি ভিকটিমের (ভুক্তভোগী) অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে জঙ্গিবাদ, গুপ্তহত্যায় মুক্তচিন্তার মানুষের বিরুদ্ধে যে অবস্থান, তাতে যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ না হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে।’

১৯৯৮ সালে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে। পরে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় রুবেল মারা যায়। পুলিশ হেফাজতে রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের দায়ের করা রিট মামলায় ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এক রায়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান ছয় মাসের মধ্যে সংশোধন করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে বলা হয়।

এর পর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে আপিল দায়ের করে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। তখন আপিল বিভাগ লিভ পিটিশন মঞ্জুর করলেও হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো স্থগিত করেনি।

২০১০ সালের ১১ আগস্ট মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। তখন আদালত হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সরকারকে তা জানাতে বলেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও জনগুরুত্বপূর্ণ মামলার ওই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা আদালতকে অবহিত করতে পারেনি সরকার।

ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।

খ. কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।

গ. গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে।

ঘ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতার ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে।

ঙ. গ্রেফতার ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।

চ. গ্রেফতার ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবে।

ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে।

জ. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।

হাই কোর্টের ওই আদেশ পুলিশ না মানায় মঙ্গলবার আদালতে ক্ষব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।
 

পাঠকের মতামত: