ডেস্ক নিউজ :
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) বিভক্ত অংশ ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রধান তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বরমাসহ পাঁচজনকে হত্যার কিলিং মিশনে অংশ নেয় দুটি গ্রুপ।
তপনজ্যোতির মৃত্যু নিশ্চিত করতে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তপনজ্যোতি চাকমা বর্মাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নেতাদের।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক নয়নময় ত্রিপুরা জানান, নিহতদের প্রত্যেকের মাথায় গুলির চিহ্ন আছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাদের মাথায় খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়।
ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) কর্মী ঝিমিত চাকমার বরাত দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে নানিয়ারচর-মহালছড়ি সীমান্তের কেংড়াছড়ি এলাকায় ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মোট ১৩টি মাইক্রোবাসযোগে শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যে যাওয়ার কথা ছিল তাদের।
হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকা সশস্ত্র দুটি গ্রুপ। একটি গ্রুপ রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের বেতছড়ি এলাকার ছোট্ট একটি টিলার ওপর অবস্থান নেয়। অন্য গ্রুপটি সড়কের পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। প্রথমে তপনজ্যোতি ও তার সঙ্গীদের বহন করা মাইক্রোবাসচালক সজীব হাওলাদারকে গুলি করা হয়। তখন গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের টিলায় ধাক্কা খায়। এরপর খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
সূত্রটি জানায়, তপনজ্যোতি চাকমার মাথার পেছনের অংশে গুলি লেগে মগজ বেরিয়ে আসে। অন্য দু’জনের মধ্যে একজনের কানের পাশে গুলি লাগে এবং অন্যজনের শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। যেখানে হামলার ঘটনা ঘটে সেখানে টিলার ওপর একটি বাঁশের বেড়া ও টিনের তৈরি পরিত্যক্ত ঘর ছিল। ওই ঘরের আঙিনা থেকে প্রথমে গুলি চালানো হয়। কোনো গ্রুপ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে যাতে অন্য গ্রুপ হামলা করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, তপনজ্যোতির মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় ঘাতক দুটি গ্রুপ।
বিরোধের শুরু যেখানে
২০১৭ সালে ১৫ নভেম্বর তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে গঠন হয় নতুন রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করায় যেন নিজের মৃত্যু ডেকে আনেন তপন।
তপনজ্যোতি চাকমা পার্বত্য রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ির বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় ‘বর্মা’ নামেই পরিচিত। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে জন্ম নেয়া পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফের সশস্ত্র শাখার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তার মাধ্যমে গত দুই দশক ওই এলাকায় নিজেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে ইউপিডিএফ।
২০১৭ সালের শুরুতে টানাপোড়েন তৈরি হয় ইউপিডিএফ নেতৃত্বের। ওই টানাপোড়েনের কারণে নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমার হাত ধরে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকা জনসংহতি সমিতিতে (এমএন লারমা) যোগ দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তপন ও তার কিছু অনুসারী। কিন্তু ওই বছরেই পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে একটি অদৃশ্য ‘সমন্বয় ও সমঝোতা’ হলে আর তাকে নিতে পারেনি জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এসে খাগড়াছড়ি শহরে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পৃথক দলের ঘোষণা দেন তপন। সঙ্গে থাকেন একসময় সশস্ত্র সহযোদ্ধা হিসেবে থাকা অন্তত শ’খানেক নেতাকর্মী। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর গত তিন মাসে অন্তত পাঁচ ইউপিডিএফ সদস্য নিহত হন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন মিঠুন চাকমার মতো ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতা।
অভিযোগ রয়েছে, গত মার্চ মাসে ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন হিল উইমেনস ফেডারেশনের দুই শীর্ষ নেত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। প্রায় ৩২ দিন পর ওই দুই নেত্রী মুক্তি পেলেও ওই ঘটনায় তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয় ইউপিডিএফ। এ কারণে শক্তিমান চাকমা ও তপন জ্যোতি চাকমা হয়ে ওঠেন ইউপিডিএফের মূল টার্গেট!
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে ২৬ ডিসেম্বর প্রসিত খিসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউপিডিএফ। সংগঠনটি শুরু থেকে সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী দল সন্তু লারমার নেতৃত্বে থাকা জনসংহতি সমিতির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। মারা যান উভয় পক্ষের সাড়ে ৬শ’র অধিক নেতাকর্মী।
পরবর্তীতে জরুরি অবস্থাকালীন ২০১০ সালে সন্তু লারমা দল থেকে সরে গিয়ে সুধাসিন্ধু খিসা, তাতিন্দ্রলাল চাকমা পেলে ও শক্তিমান চাকমার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস এমএন লারমা নামে নতুন সংগঠন। সংগঠনটি প্রসিতের ইউপিডিএফের সঙ্গে সখ্য গড়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং সন্তু লারমা জেএসএসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ২০১৫ সালের শেষের দিকে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে দলীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
জেএসএস (এমএন) লারমা, প্রসিত খিসার ইউপিডিএফ ও মূল জেএসএসের সঙ্গে বিরোধে লম্বা হয় লাশের মিছিল। তিন পক্ষের মারা যান অন্তত ৭১৬ জন। তাদের মধ্যে জেএসএসের ৩৯৫ জন, ইউপিডিএফের ২৭৫ জন, এমএন লারমা গ্রুপের ৪৬ জন। একপর্যায়ে ২০১৫ সালে তিন পক্ষ অলিখিত সমঝোতা করে সংঘাত বন্ধ করে।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রসিতের ইউপিডিএফ থেকে সরে গিয়ে তপনজ্যোতি চাকমা বর্মা গঠন করেন ইউপিডিএফ (গণতন্ত্র) নামে নতুন সংগঠন। দলটি জেএসএস এমএন লারমা দলের সঙ্গে সখ্য গড়ে মূল ইউপিডিএফের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। ২০১৭ সালে ৫ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির নানিয়াচর উপজেলার ১৮ মাইল এলাকায় অনাদী রঞ্জন চাকমাকে হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। যা বর্তমানে অব্যাহত আছে।
পাঠকের মতামত: