অনলাইন ডেস্ক :: দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘শূন্য’ সহিষুষ্ণতার অঙ্গীকার রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি নির্মূলে কোনোরকম অনুকম্পা নয় বলে তার দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান। অনিয়ম-দুর্নীতি সহ্য করা হবে না বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অঙ্গীকার ও দৃঢ় অবস্থান ব্যাধিগ্রস্ত সমাজে দেখিয়েছে আশার আলো। তবে এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। সরকারপ্রধানের এমন কঠোর অবস্থানের পরও উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমেনি দুর্নীতি। বরং বহুবার সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। এর ফলে শঙ্কা থেকেই যায়— উন্নয়নে সরকারের এত চেষ্টা কীভাবে সফল হবে? আর তাই এবার আমলাদের দুর্নীতি রোধে আঁটঘাঁট বেঁধে মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগ রয়েছে, স্বাধীনতাপরবর্তী ৫০ বছরে আমলাতন্ত্রের মহীরুহ বড় হতে হতে দৈত্যাকৃতি দানবে পরিণত হয়েছে। কাগজে-কলমে দেশের মালিক জনগণ। তবুও মালিকদেরই দেশের ‘চাকর’ আমলাদের ‘স্যার’ বলতে হচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে সরকারি সেবা নিতে গেলে তারাই জনগণকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদিতার জন্য আমলাদের দুর্নীতি ভয়াবহ। সেবাগ্রহীতাদের জীবনকে তারা দুর্বিষহ করে তোলেন। তবে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ় অঙ্গীকারের অভাব আমলাদের দুর্নীতির জন্য বহুলাংশে দায়ী। আমলারা সংখ্যায় রাজনীতিবিদদের থেকে অনেক বেশি।
রাজনীতিবিদরা সাময়িক আর আমলারা স্থায়ী। সরকারের ক্ষমতা আমলাদের নথিতেই আটকানো থাকে। ক্ষমতাই দুর্নীতির উৎস। তাই আমলাদের দুর্নীতি অধিক দৃশ্যমান। তবে সব রাজনীতিবিদ দুর্নীতিপরায়ণ নন। সব সরকারি কর্মচারীও দুর্নীতিপরায়ণ নন।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি দমন হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দুর্নীতিবাজরা যদি বেঁচে যায়, তাহলে বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। দুদকসহ শুদ্ধাচার কৌশল-সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল জেলা জজ আদালতসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, দেশের সব আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরসহ প্রায় সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহূত ফোন দুদক বিশেষ নজরদারিতে রেখেছে। আর এই সূত্র ধরে চলতি বছরে মাঝামাঝি সময়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করতে পারে দুদক।
দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আগামীতে দুদকের তদন্ত, গ্রেফতার অভিযান আরো বেগবান করা হবে। শুধু দুদক প্রধান কার্যালয় না, আমাদের বিভাগ রয়েছে ৮টি, উপজেলা জেলা সব জায়গাতেই দুদকের কার্যক্রম দেখতে পাবেন। দুদক বসে নেই, দুদকের কার্যক্রম চলছে। একটু অপেক্ষা করেন।
সেবা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্পর্কে দুদক সচিব বলেন, ‘সেবা খাত আমাদের জীবন-যাত্রার বাইরে না। আমাদের এনফোর্সমেন্ট টিম ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত থাকে। অভিযোগ পাওয়ার পর আমার যাচাই করি। যদি দেখি এখানে দুর্নীতি বা অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তৎক্ষণাৎ অভিযান পরিচালনা করি।’
তিনি বলেন, অভিযানের ক্ষেত্রে কখনো মামলা আবার কখনো প্রয়োজন হলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এনফোর্সমেন্ট টিম। বিধানের আলোকে আমাদের যা করণীয় আমরা সেটাই করি। সবকিছুর বিষয়ে দুদকের সর্বদা নজর থাকে। কেউ যদি দুর্নীতি বা অনিয়ম করে থাকে তার বিরুদ্ধে বিধান মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শগত অবস্থান থেকে বিচ্যুতিতে রাজনৈতিক দুর্নীতির পাশাপাশি বাড়ছে কিছু আমলাদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া। নীতিভ্রষ্ট রাজনীতিবিদরা তাদের দুর্নীতি শতভাগ সফল করতে সংশ্লিষ্ট দফতরের আমলাদের অংশীদার করছে। রাজনীতিবিদ আর আমলাদের যোগসাজশেই দুর্নীতি হয়। এমনকি বড়মাপের দুর্নীতির ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। রাজনীতিবিদেরা চাইলেই দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ সম্ভব। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ব্যবস্থাপনা দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের প্রধান নিয়ামক। আর তাই আমলাদের দুর্নীতি রোধে এরই মধ্যে তাদের ওপর নজরদারি করতে মোবাইল ফোনে বিশেষ পন্থায় দুদক লক্ষ্য রাখছে বলে জানা যায়।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়তে হলে সরকারি নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি, পদায়ন, শৃঙ্খলা ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছ এবং বৈষম্যহীন নীতিমালা প্রয়োজন। সুশাসন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক জবাবদিহির ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচনি দুর্নীতি প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘অনেকেই নির্বাচনে জিতে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান। তাদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে ওঠে।’ তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের দেয়া হলফনামার তথ্য তুলনা করে খতিয়ে দেখলে অনেক রাঘব-বোয়ালকে ধরা যাবে। বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক যদি ব্যবস্থা নিতে না পারে, তাহলে দুদক বেশি দূর আগাতে পারবে না।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার জহুরুল হক বলেন, ‘আমরা দেশ থেকে দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারিনি। তবে দুর্নীতিবাজদের ভয় দেখাতে পেরেছি। আমরা চেষ্টা করছি— যাতে দেশে দুর্নীতির বিস্তার না ঘটে।’
জহুরুল হক বলেন, ‘কক্সবাজারে ৩ লাখ ৭০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এ উন্নয়ন প্রকল্পে যাতে কোনো দুর্নীতি না হয়, সেজন্য আমরা সজাগ আছি। আমরা কক্সবাজারে অফিস চালু করেছি। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে দেশের ১৪টি জেলায় দুদকের জেলা কার্যালয় চালু করা হবে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, লালমনিরহাট, চাঁদপুর ও পিরোজপুর জেলায় কার্যালয় চালু করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করছি; যাতে সাধারণ মানুষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সহজেই দুদকের কাছে অভিযোগ জানাতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করুন, দুদকের এখতিয়ারভুক্ত হলে ব্যবস্থা নেব।’
দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে দুর্নীতিবাজদের দেশে-বিদেশে থাকা ২৩৪ কোটি ২৫ লাখ ৯৬ টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ ও ক্রোক করা হয়েছে। ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে ২২ কোটি ৭৮ লাখ ৪১ হাজার ৯৯ টাকা মূল্যের ১৪.৪৪ একর জমি। ৩৮ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ২৭২ টাকা মূল্যের ১৭টি বাড়ি, ৭ কোটি ২২ লাখ টাকা মূল্যের ১৭টি ফ্ল্যাট, ৩৬ কেটি টাকা মূল্যের চারটি কমার্শিয়াল স্পেস, ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ৯টি গাড়ি ও ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের চারটি স্থাপনা। এসবের মোট আর্থিক মূল্য ছিল ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ ৩০ হাজার ২১১ টাকা। আর অবরুদ্ধ করা হয় ২৮৮টি ব্যাংক হিসাব, ছয়টি বিও হিসাব, ৩৬টি সঞ্চয়পত্র, জামানত হিসাবে ২ কোটি ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৪৪ টাকা ও ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের পলিসি রয়েছে।
দুবাইয়ে দুটি শেয়ার ও মালয়েশিয়ায় ৫টি ব্যাংক হিসাবও ওই বছর অবরুদ্ধ হয়। সব মিলিয়ে ১১৮ কোটি টাকা ৫৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৬ টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়। ২০২০ সালে ৩৩২ কোটি ১৬ লাখ ২৮ হাজার ২৪২ টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে ১৮০ কোটি ১১ লাখ ৯১ লাখ ৭৪৬ টাকার স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে ২৫৬.৩৪৫ একর জমি। যার বাজারদর ১০৮ কোটি টাকার বেশি। ২৮ কোটি টাকার ৩৪টি বাড়ি, ১৪ কোটি মূল্যের ৩৫টি ফ্ল্যাট, ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা মূল্যের ১১টি প্লট, ৩ কোটি টাকা মূল্যের ৭টি কর্মাশিয়াল স্পেস ও ২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা মূল্যের ১৭টি গাড়ি। এছাড়া ১ হাজার ১১৮টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৬১ কোটি ৪ লাখ, সঞ্চয়পত্রের ৮৮ লাখ, ৯০ কোটি ৯৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ৫ লাখ টাকার পিস্তল অবরুদ্ধ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ১৫২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। শুধু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্তই ৩২৪ কোটি ৫৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫৯২ স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। আর অবরুদ্ধ করা হয় ১১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ। ক্রোকের মধ্যে রয়েছে ২৫৫ কোটি টাকার ১২৭ একর জমি, ২৬ কোটি টাকা মূল্যের ৩০টি বাড়ি, ৩৫ কোটি মূল্যের ১৪টি ফ্ল্যাট, ৩৩ লাখ টাকার মূল্যে একটি প্লট ও ৭ কোটি টাকা মূল্যের ২৭টি গাড়ি। আর অবরুদ্ধ সম্পত্তির মধ্যে ৯১৬টি ব্যাংক হিসাব, ৫৬টি সঞ্চয়পত্র, বন্ড ও শেয়ার, ৩টি পিস্তল এবং ৭টি জাহাজ। কানাডায় ১১টি ব্যাংক হিসাব, অস্ট্রেলিয়ায় ২৩টি ব্যাংক হিসাব ও সিঙ্গাপুরে ৫টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। অবরুদ্ধ এসব সম্পদের মোট পরিমাণ ১ হাজার ১৬৭ কোটি ৭ লাখ ১৫ হাজার ৬০৪ টাকা। নয়া শতাব্দী
পাঠকের মতামত: