ঢাকা,বুধবার, ৮ মে ২০২৪

বিগত ৫ বছরেও সুফল পায়নি পৌরবাসী

চকরিয়া পৌর শহরজুড়ে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ, দুর্গন্ধে আর দুর্ভোগে জনগন

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: চকরিয়া পৌর শহরজুড়ে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ: ৫ বছরেও সুফল পায়নি পৌরবাসী
চকরিয়া পৌরসভা শুরু মাতামুহুরী ব্রিজ থেকে। ময়লা-আবর্জনার শুরুটাও সেখান থেকে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাতামুহুরী ব্রিজ থেকে পৌরসভার শেষ সীমানা ভেন্ডিবাজার পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে ময়লা আর ময়লা। পৌরশহরের বিপনী বিতানগুলোর সামনে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। এ নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই পৌরসবাসীর। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় সমালোচনা চলছে সর্বত্র।

পৌরশহরে ময়লা-আবর্জনার ইতিহাস নতুন নয়। সময়ের প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আয়তনের দিক থেকে জেলার সর্ববৃহৎ পৌরসভার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা খুবই নগন্য। জনসংখ্যা রয়েছে কয়েক লক্ষাধিক। অথচ পয়োনিষ্কাশণ ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা।

পৌরসভার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার আশপাশে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা। অবশ্য এর জন্য অসচেতন নাগরিকরাও দায় এড়াতে পারেন না। আর পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সর্বস্তরের মানুষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সড়কের কাঁচাবাজার এলাকায় একটি ভ্যানগাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে বাজারের পচেগলে যাওয়া আবর্জনা উপচে পড়ছে। একটু এগিয়ে যেতেই হিরণ পয়েন্টে হয়ে হাসপাতালের পিছনের সড়কে প্রতিটি বাসাবাড়ির আবর্জনা রাস্তার পাশে পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

ওয়াপদা রোডে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেয়াল ঘেষা ডাস্টবিনের ভেতরে যতটা আবর্জনা আছে, বাইরে তার চাইতে বেশী। হিন্দুপাড়া পাঁচরাস্তা মোড়ে সড়কের ওপর পড়ে আছে ময়লা।বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়াল ঘেষেও রয়েছে অনির্ধারিত একটি ডাস্টমিন। ডাস্টবিনের ৫০গজের মধ্যে ক্লাস করেন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পথ চলতে হয় নাক-মুখ চেপে ধরে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পৌর কর্তৃপক্ষের ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহে যতেষ্ট আন্তরিক না হওয়ায় বাসাবাড়ির মালিকদের উদাসিনতার কারণে ভাড়াটিয়ারা বাসার সামনে সড়কেই ময়লা ফেলে চলে যায়। পৌর কর্তৃপক্ষ বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেই।

পৌরশহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সড়ক। এই সড়কে রয়েছে প্রায় ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পৌর ভবনের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে চকরিয়ার একমাত্র মহিলা কলেজ অবস্থিত। কলেজটির পাশেই রয়েছে একটি বড় ডাস্টমিন। বেলা গড়াতেই ডাস্টমিনের ময়লা কানায় কানায় পূর্ণ হয়। পরে ময়লাগুলো সড়ক অবধি গড়িয়ে যায়। ওই কলেজ ছাড়াও প্রত্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনার মাড়িয়ে ক্লাসে যায়। মগবাজার রোড়ে চকরিয়া থানার সীমানা দেয়ালের লাগোয়া একটি জায়গা ডাস্টমিনে পরিণত হয়েছে। সেখানের ময়লা রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে নিয়মিত। এই রকম শতাধিক ডাস্টমিন রয়েছে পৌর শহরে।

জানা যায়, ২০১৬ সালে চকরিয়া পৌরসভা নির্বাচনে নানা অব্যবস্থাপনকে পুঁজি করে মেয়র পদে আলমগীর চৌধুরীর প্রতি আগ্রহের কারণে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। পয়োনিষ্কাশন ও ময়লার-আবর্জনা ব্যবস্থা উন্নতি নিয়ে তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিলো উচ্চমাত্রায়। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় মানুষের সেই আগ্রহ ভাটা পড়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করছে, আগামী নির্বাচনে এই নিয়ে চরম বেগ পোহাতে হবে তাকে। কারণ পৌরশহরে মুল প্রাণ কেন্দ্রই নানা অব্যবস্থাপনা ও পৌর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা রয়েছে।

সচেতন মহলের অভিমত, একটা বিষয়ে সুস্পষ্ট নাগরিকেরা নিজের বাসাবাড়ি, রান্নাঘর কিংবা মার্কেটের সামনে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে যতটা ভাবে, শহরের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ততটা ভাবে না। পৌর কর্তৃপক্ষও খুব একটা উদ্যোগী, তা তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হয় না। না হলে ময়লার ডাস্টমিন কেন সড়কের থাকবে? আর ফুটপাতেই বা কেন পর্যাপ্ত ডাস্টবিন থাকবে না?

জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য জিয়া উদ্দিন চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘চকরিয়া পৌরশহরের প্রধান সড়কে এখন হাঁটাচলা করাও দায় হয়ে পড়েছে। চকরিয়া পৌরসভা সুন্দর শহর হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু জনগণের সেই আশা পূরণ হয়নি। শহরের ময়লা-আবর্জনা অসহনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ নির্বাচনের আগে সব প্রার্থী সুন্দর শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মানুষকে ভোগান্তির শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।’

চকরিয়া পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, বর্জ্য পরিবহনে পৌরসভার ৬টি গার্বেজ ট্রাক আছে। এর মধ্যে ৩টি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বর্জ্য অপসারণে ভ্যাকুম ট্যাংকার ১টি ও স্কীট লোডার আছে ১টি। এছাড়াও বর্জ্য পরিবহনের জন্য ভ্যানগাড়ি আছে ৭টি। পরিচ্ছন্ন কর্মী আছে ৩১জন। তিন বছর আগে বর্জ্য ফেলার জন্য একটি জায়গার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে। শহর থেকে ৫কিলোমিটার দূরে ইসলামপুর ও বানিয়াছড়ার মধ্যখানে সেই জায়গা ময়লা ফেলা হয়।

চকরিয়া পৌরসভার ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেটে রাজস্বখাতে নর্দমা পরিষ্কার, ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের যন্ত্রপাতি উপকরণ ক্রয় ও ডাম্পিং ষ্টেশন নির্মাণ বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৯০ লাখ টাকা। একই বাজেটে মেথর/সুইপার/ঝড়ুদারদের বেতন ভাতা প্রদান করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। সেই হিসেবে শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতি বছর চকরিয়া পৌরসভাকে ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। তবে খোদ পৌরসভার একজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, সেই জায়গায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ময়লা ফেলা হচ্ছে।

চকরিয়া পৌরসভা পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক আবুল কালাম চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘শহরের পরিচ্ছন্নতার কাজে ৩১ জন পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়মিত পৌরশহরে কাজ করছে। আয়তনের দিক থেকে চকরিয়া পৌরসভা বড় হলেও জনবল কম।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, পয়ো ও বর্জ্য সমস্যার পাশাপাশি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া পৌরশহরের চিরিঙ্গা স্টেশনে এলাকায় প্রতিদিনকার যানজট পৌরবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সকাল দশটা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত যানজটের কবলে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। ফলে যানজটের প্রভাব শহরের অন্য সড়কেও পড়ে। সড়কের ফুটপাতও ইজারা দিয়েছে পৌরসভা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের ফুটপাত, টমটম, সিএনজি স্টেশন অলিখিত ইজারা দিয়েছে পৌরসভা। ফুটপাত ইজারার দোষ সচিবের গাঙে ছাপিয়ে দেন পৌরসভার দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তা। অনেকের মতে পৌরশহরে ফুটপাতে ময়লা-আবর্জনা সৃষ্টির পেছনে দায়ি ফল ব্যবসায়ীরা। গত দুইবছরে একাধিকবার ত্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযোগ পরিচালনা করে চকরিয়া পৌর কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসন। এর কোন ফল পায়নি পৌরবাসী। অভিযানের পর ফের হকাররা ফুটপাত দখলে নেয়। কিন্তু এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বাস্তব কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

এই বিষয়ে চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘চকরিয়া পৌরসভায় পয়োনিষ্কাশন ও ময়লার-আবর্জনা ব্যবস্থা উন্নতি হয়েছে। আমরা ময়লা ফেলার জন্য শহর দূরে একটি জায়গা ভাড়া করেছিলাম। ময়লার-আবর্জনার থেকে স্থায়ী সমাধান পেতে জায়গাসহ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ইতিমধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা)’র কাছে আবেদন করেছি। আবেদনটি বাস্তবায়নের পথে আছে।’

 

পাঠকের মতামত: