ঢাকা,শনিবার, ৪ মে ২০২৪

হাইড্রোজেন গ্যাস বেলুন ব্যবহারে বাড়ছে দূর্ঘটনা 

গ্যাস বেলুন বিক্রি বন্ধসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবী বিভিন্ন মহলের

মো. সাইফুল ইসলাম খোকন :: কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ের বাসিন্দা বেলুন বিক্রেতা জসিম উদ্দিন(৩৫)। বেলুন বিক্রয় করতে গিয়ে বাড়ি ফেরা হয়নি দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী থেকে। লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। সাথে তার গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩ শিশু নিহত ও ১০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। গত ২২ জানুয়ারি মাতারবাড়ী আজিজুল উলুম মাদ্রাসার সভা উপলক্ষে পার্শ্ববর্তী মাতারবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বসা মেলায় হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ভর্তি করে বেলুন ফুলানোর সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এ মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর উপজেলা প্রশাসন ওই এলাকায় যে কোন অনুষ্ঠানে বেলুন বিক্রি বন্ধসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এক আদেশ জারি করে।

গ্যাস ভর্তি বেলুন। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। সুতা দিয়ে বাঁধা। দেখতে খুব সুন্দর। এসব খেলনা বেলুন ছেয়ে গেছে কক্সবাজার জেলাসহ সারাদেশ। এ বেলুন ফুলিয়ে রাখতে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরিতে অ্যাসিড ব্যবহারের কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও বেলুন বিক্রি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন পদক্ষেপ নেই। বরং এ বেলুনের বেচাকেনা বেড়েছে দ্বিগুণ।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। হাইড্রোজন গ্যাস ভর্তি এসব বাহারি বেলুন আসলেই হতে পারে প্রাণঘাতী বিষ্ফোরক। ঝলসে যেতে পারে যে কোন মানুষের মুখসহ সারা শরীর। আর এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবার আশঙ্ক রয়েছে শিশুদের। গত ২২ জানুয়ারি মাতারবাড়ী আজিজুল উলুম মাদ্রাসার সভা উপলক্ষে পার্শ্ববর্তী মাতারবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বসা মেলায় হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ভর্তি করে বেলুন ফুলানোর সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩ শিশু নিহত ও ১০ জন মারাত্মকভাবে আহত ঘটনা বাস্তব প্রমাণ।

নিহতরা হলেন- ওই ইউনিয়নের মিয়াজী পাড়া গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীরের পুত্র আহসান (১২), বলির পাড়া গ্রামের আজিজুল হকের পুত্র এরশাদ (১০) ও বেলুন বিক্রেতা চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ের বাসিন্দা জসিম (৩৫)।

আহতরা হলেন- মাতারবাড়ী বলির পাড়া রাজঘাটের কাইছারুল ইসলামের ছেলে জিহাদুল ইসলাম আব্দুল্লাহ (১২),কালারমারছড়া ইউনিয়নের নুর মোহাম্মদের ছেলে মারুফ (১২), মাতারবাড়ী সিকদার পাড়া ফরিদুল আলম সাদেকুল ইসলাম রাহাত (১৩), একই এলাকার মগডেইলে আব্দুল মন্নান মোঃ নুরী (১৩), একই এলাকার সিকদার পাড়া আব্দুল মোনাফ তুহিন (১৪) একই এলাকার পশ্চিম সিকদার পাড়া বদনের পুত্র জয়নাল (১২), একই এলাকার সিকদার পাড়ার জসিমের পুত্র শেকাব উদ্দীন (১৫) শাপলাপুর ষাইটমারার নুরুল হকের পুত্র আক্কাস (১৮) শাপলাপুর জেএমঘাটের কবির আহমদের পুত্র নুরী (১৫)।

বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী মো: সেলিম উল্লাহ রাজু বলেনম এইসব বেলুন শিশুরা দেখলেই বায়না ধরে কিনার জন্য। অভিভাকরাও আদরের শিশুর হাতে এটি তুলে দিতে কার্পণ্য করছেন না। শিশুদের হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে এসব বেলুন। শুধু শহরে নয় হাতে হাতে গ্রামেও ছড়িয়ে যাচ্ছে এসব বেলুন। অসাবধানতার কারণে কোনো শিশুর হাত থেকে ছুটে গেলেই এসব বেলুন উড়ে যায় দূর আকাশে! অভিভাবকরা হয়তো ভাবতেই চান না এই সুন্দর খেলনাটি শিশুর শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর! এমনকি বেলুনের ভিতরে থাকা গ্যাসের কারণে মৃত্যুও হতে পারে।

চকরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জিয়াবুল হক ভূট্টো উপরোক্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ার তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, হাইড্রোজেন গ্যাস হিলিয়াম থেকে অপেক্ষাকৃত হালকা এবং আকাশে আরও বেশি উচ্চতায় যেতে পারে বলে এর ব্যবহার করা হয় বেলুনে। তবে আগুনের সংস্পর্শে আনলে তা বিস্ফোরিত হবে। হাইড্রোজেন গ্যাস প্রস্তত করা খুবই সহজ। পানিকে ইলেক্ট্রলাইট করলেই হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। হাইড্রোজেন গ্যাস অতি দাহ্য বা সহজেই জ্বলে ওঠে। আচমকা কোনো বেলুন ফেটে গেলে পাশে ধূমপানরত কোন ব্যক্তির সিগারেটের আগুনই যথেষ্ট। এ থেকেই ঘটতে পারে মারাত্মক অগ্নিকান্ড। অনেকটা পেট্রোল বোমার মত। যতক্ষণ গ্যাস থাকবে ততক্ষণ আগুন স্থায়ী হবে। তিনি আরো জানান, বেলুনগুলো প্লাস্টিক ও জরি কাগজ দিয়ে তৈরি মনে হলেও ওগুলো আসলে পলিথিনেরই আরেকটি সংস্করণ। যা কোনভাবেই পচনশীল নয়। দেশে এ ধরণের পলিথিনের ব্যবহার সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী স¤প্রতি চীন থেকে প্লাস্টিকের আদলে তৈরি এসব পণ্য দেদারসে দেশে আনছে বিভিন্ন কৌশলে। দেশের বিভিন্ন স্থানেও গড়ে উঠেছে বেলুন কারখানা। গত কয়েক মাসে সারা দেশে গ্যাস ভরা ঢাউস বেলুন ফেটে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।

জেলার পেকুয়া উপজেলা সরকারী হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মোহাম্মদ ছাবের , বলেন একটি বেলুনে যে পরিমাণ গ্যাস ভরা থাকে তা অতিমাত্রায় দাহ্য। এতে আগুন লাগলে একটি ৫ বছর বয়সী শিশুর শরীরের ১০ ভাগ পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরাসরি সালফিউরিক অথবা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ব্যবহার হচ্ছে বেলুন ফোলানো হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরিতে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে মারাত্মক এসব অ্যাসিডের বিক্রি বা উৎস কোথায়? পরিবেশ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স এবং নিয়মনীতি না মেনে অ্যাসিড বিক্রি ও মজুদ আইনত দন্ডনীয় হলেও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে এই বেচাকেনা ও তার অপব্যবহার?

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান জানান, গত ২২ জানুয়ারি মাতারবাড়ী আজিজুল উলুম মাদ্রাসার সভা উপলক্ষে পার্শ্ববর্তী মাতারবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বসা মেলায় হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ভর্তি করে বেলুন ফুলানোর সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩ শিশু নিহত ও ১০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এছাড়াও, বিগত ১৮ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারী মহেশখালীর আদিনাথ মেলায় বেলুন ফুলানাের গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ২ জন নিহত ও ৪ জন আহতের ঘটনা ঘটে। বেলুন ফুলানাের জন্য হিলিয়াম গ্যাস সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার আশায় হিলিয়াম গ্যাসের পরিবর্তে বিপদজনক হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে বিধায় সারাদেশে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটছে। মহেশখালীতে বিভিন্ন জনসমাবেশ, হাট-বাজার, অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও র্বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে কেউ যাতে বিপদজনক হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি বেলুন বিক্রি করতে গিয়ে আবারও যাতে প্রাণঘাতী ও বিধ্বংসী এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটায় সে বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন বিষয়টি কার্যকর করার জন্য মহেশখালীর সকল ইউপি চেয়ারম্যান ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো: হাসানুজ্জামান পিপিএম. ক্ষতিকারক ও বিপদজ্জনক বেলুন বিক্রি বন্ধ করা প্রসঙ্গে বলেন, শিশুসহ সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ দ্রæত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। গ্যাস বেলুনে দুর্ঘটনা ঘটার আগেই এর লাগাম টেনে ধরতে হবে।

 

পাঠকের মতামত: