ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ-বেত

নিউজ ডেস্ক :: এক সময়ে মানুষ একটু ফুরসত পেলেই বাঁশ-বেতের পাটি, খাঁচা, মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুড়ি, ডুলা, মোড়াসহ বিভিন্ন ঘরের কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র বানাতে বসে পড়তো। গ্রাম-বাংলায় এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না, বিলুপ্তির পথে এখন এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প।
সাধারণত গ্রামের লোকেরাই বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে জড়িত। তাই এ শিল্পকে গ্রামীণ লোকশিল্প বলা হয়। কালের বিবর্তনে এবং প্রযুক্তির বদৌলতে ভারতীয় উপমহাদেশের পুরনো এ শিল্পের ঐতিহ্য আজ আমাদের মাঝ থেকে হারাতে বসেছে। তার স্থানে দখল করে নিচ্ছে প্লাস্টিক ও কাঠের তৈরি জিনিসপত্র। এর মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের কদর বেশি।
এক সময় দেশের বিভিন্ন জনপদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই এই শিল্প নির্ভর পেশাজীবীই ছিল। উপজেলাব্যাপী অন্তত সহস্রাধিক পরিবারের হাজার হাজার নারী-পুরুষ বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। বাঁশ-বেত দিয়ে ঘরের কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র তৈরি করতেন তারা। এসব জিনিসপত্রের কদরও ছিল ভালোই। ফলে এ শিল্প থেকে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন।
কালের আবর্তে, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন বহু আগেই। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে বন-জঙ্গল উজাড়, বাঁশ-বেতের কম উৎপাদন, পুঁজি, উদ্যোগ ও পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পেশা পরিবর্তন করছেন এ শিল্পের কারিগররা। ধাতব ও প্লাস্টিক পণ্যের কবলে পড়ে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীনতম শিল্পটি ক্রমশ মুখ থুবড়ে পড়ছে। যার ফলে ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির চরম দুর্দিন চলছে। এ দুর্দিন কাটিয়ে এ শিল্পের সুদিন ফিরিয়ে আনতে নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ।
একদিকে বেত ও বাঁশের সংকটের কারণ ও অভাবের তাড়নায় এই শিল্পের কারিগররা দীর্ঘদিনের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ অনেকে অন্য পেশার দিকে ছুটে যাচ্ছে। শত অভাব-অনটনের মাঝেও এখনো কয়েকটি গ্রামে হাতেগোনা কয়েক পরিবার আজও পৈতৃক এই পেশাটি ধরে রেখেছেন।
উপজেলার মিঠানালা গ্রামের বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে জড়িত রুপালী দাস ও স্বামী অনুপম দাস এর সাথে কথা বলে জানা যায়, অতীতে বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি ঘর (বসতঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর), কুলা, চালুন, খাঁচা, মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুঁড়ি, ডুলা, মোড়া, মাছ ধরার চাঁই, মাথাল, আরাম কেদারা, সোফাসেট, বইপত্র রাখার তাক, ঝাপ, বেলকি, দরমাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী এবং আসবাবপত্র তৈরি হতো। বাজারে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ও প্রচলন ছিলো।
তারা জানান, এক সময় গ্রাম এলাকায় প্রচুর বাঁশ-বেত পাওয়া যেতো। যার ফলে তাদের এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় ও থানায় (জেলা ও উপজেলা) শত শত মানুষ বাঁশ ও বেত শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন ধাতব ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার, প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বেত না পাওয়া, পুঁজি এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এ শিল্পের বেশিরভাগ মানুষ এ পেশাটি ছেড়ে দিয়েছেন।
যারা এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন, তাদের অনেকেই সরকারি-বেসরকারি কোন রকমের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই টিকে আছেন। বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি উৎপাদন করেও তা ন্যায্যমূল্যে বাজারে বিক্রি করতে না পারায় তাদের ঘরে অভাব অনটন লেগেই আছে। এতে প্রয়োজনের তুলনায় দৈনিক আয় কম হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছেন ।
বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে জড়িত দুর্গাপুর গ্রামের শহিদুল্লাহ জানান, বাধ্য হয়ে অনেকে এ কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা বংশ পরম্পরায় এবং পূর্ব-পুরুষ থেকে চলে আসা এই পেশা আঁকড়ে ধরে রেখেছি। এখানে সরকারিভাবে কারো প্রশিক্ষণ নেই।
তিনি বলেন, আগে বড় ও মাঝারি সাইজের বাঁশ ৫০-১৫০ টাকায় কেনা যেতো। এখন ২০০-৩৫০ টাকায় কিনতে হয়। প্রায় দুইদিনের (১২+১২ ঘণ্টা) পরিশ্রমে একটি বড় বাঁশ দিয়ে ১০টি খাঁচা তৈরি করা যায়। আর প্রতিটি ৫০-৮০ টাকা করে ১০টি খাঁচা ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে আমাদের পোষায় না। তবে পাইকাররা এইসব খাঁচা ২০০ টাকায় ও বিক্রি করে বলে জানা গেছে।
এক সময়ে এ পেশার সাথে জড়িত থাকা এক পরিবার জানান, বাঁশের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাঁশের তৈরি পণ্যের দাম বাড়েনি। যার ফলে আমরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছিনা।
এই বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রঘুনাথ নাহা জানান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব। উপজেলায় বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে যারা জড়িত, তারা যদি উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চায়, তাহলে আমরা উপজেলা বিআরডিবি, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, একটি বাড়ি একটি খামার, যুব উন্নয়ন, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ সহযোগিতাসহ যা করা প্রয়োজন, তা আমরা করবো।

পাঠকের মতামত: