ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়ার বমুবিলছড়ি ইউপি নির্বাচন বিএনপির বর্তমান কমিটির দুই নেতা দু‘ মেরুতে মতলব ধানের শীষে, কামাল নৌকায়

110-300x141ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া  :::::
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ছিটমহলখ্যাত বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান কমিটির সভাপতি আবদুল মতলব ও সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন। দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে দুইজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এতদিন ধরে রাজনীতির মাঠে একইবৃত্তে থাকলেও দুইজনের সম্পর্কে চিড় ধরে প্রায় একবছর আগে থেকে। এর পরও দুইজনই দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকলেও এখন অবস্থান করছেন দুই রাজনৈতিক মেরুতে।
জানা গেছে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই ইউনিয়ন থেকে দুইজনই চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আবদুল মতলব বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক এবং কামাল উদ্দিন (বর্তমান চেয়ারম্যান) আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর দুইজনের গণসংযোগের সময় পিছু নিচ্ছেন কৌতুহলী অসংখ্য মানুষ। কারণ দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে থাকলেও দুইজন দুই মেরুতে অবস্থান করায় ভোটের মাঠে একে অপরের বিরুদ্ধে কোন ধরণের কথা বলে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন তা প্রত্যক্ষ করতে।
বিএনপি প্রার্থী আবদুল মতলব ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামাল উদ্দিনের গণসংযোগ প্রত্যক্ষ করতে পিছু নেওয়া এলাকার অসংখ্য সচেতন ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কামাল উদ্দিন বিএনপির রাজনীতি করেছেন। এই সময় তিনি বিএনপির বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। এখন দেখছি তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করছেন। আবার বিএনপি প্রার্থী আবদুল মতলব দীর্ঘদিনের দলীয় সহযোদ্ধা কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে এখন কোন ধরণের বিষোদগার করে ভোটারদের অনুকম্পা পাওয়ার চেষ্টায় তার দেখার বিষয় রয়েছে। তাই কৌতুহল বশত আমরা তাদের তার পিছু নিয়েছি, আসলে তারা ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোন ধরণের কথা বলে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন তা প্রত্যক্ষ করতে।’
সচেতন ভোটারদের মধ্যে একজন হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ইদানিং বিভিন্ন মাধ্যমে এবং লোকেমুখে শোনা যায় বিশ্বের মধ্যে ‘সব সম্ভবের দেশ’ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিত বিরাজমান। এতদিন এই কথা আমি বিশ্বাস করতে না পারলেও বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। এখন উচ্চস্বরে আমারও বলতে দ্বিধা নেই, এই কথা। কেননা প্রাচীনতম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সুনাম রয়েছে। কিন্তু সেই (আওয়ামী লীগ) দলের প্রার্থী হিসেবে বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান কমিটির খোদ সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিনকে যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষাই আছি সাধারণ ভোটারের রায় কোন দিকে যায়।’
বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান আহমদ দৈনিক চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘দলীয় একক প্রার্থী নির্ধারণের ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কোন ধরণের মতামত নেওয়া হয়নি। হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড বিএনপির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিনকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ঘোষণা করায় আমরা হতভম্ব হয়ে গেছি। শত হতাশার মাঝেও মনে করেছিলাম দল যখন তাকে মনোনয়ন দিয়েছে, তখন কামাল উদ্দিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোটের মাঠে থাকবেন। কিন্তু তিনি এসবের তোয়াক্কা না করে উল্টো এলাকায় হুঙ্কার ছাড়ছেন ‘নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোট করতে হবে না, ভোটের দিন ঠিকই তিনি নানা কায়দায় ভোট আদায় করে নিতে পারবেন।’ তাই আমরাও আগ বাড়িয়ে তার কাছে ধর্ণা দেওয়ার চেষ্টাও করছিনা। তাছাড়া কামাল উদ্দিন বিগত ২০ বছর ধরে বিএনপির বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোধগার করে বক্তব্য দিয়েছেন। তাই নৈতিকভাবে তাকে সমর্থন করার কোন মানসিকতা আমার নেই। এজন্য আমি এখন ঢাকায় অবস্থান করছি।’
বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি নুরুল আবচার বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এখানকার মানুষ প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী করে আসছে। এবারও বিএনপি প্রার্থী আবদুল মতলবকে ধানের শীষ প্রতীকে রায় দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তবে দলের সঙ্গে বেইমানি করে কামাল উদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেও তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরাও তাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই আমাদের জয় আরো সহজ হয়ে গেছে।’
নির্বাচনে একক প্রার্থী ও ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবদুল মতলব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার দীর্ঘদিনের দলীয় সহযোদ্ধা কামাল উদ্দিন গত পাঁচবছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এইসময় তিনি এলাকার মানুষের আশা-আখাঙ্কার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি। তাই এবারের নির্বাচনে তার ভরাডুবির পাশাপাশি বিএনপি থেকে মনোনয়ন না পাওয়ার বিষয়টি চুড়ান্তভাবে বুঝতে পেরে ডিগবাজি খেয়েছেন। বিএনপি থেকে পদত্যাগ না করেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এখন এলাকায় গলাবাজি করছেন, প্রশাসনের সহায়তায় ভোটের দিন জনরায় কেড়ে নেবেন। তিনি যদি এই আশায় থাকেন, আমরাও প্রস্তুত রয়েছি তার এই গলাবাজির দাতভাঙা জবাব দিতে। তবে নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি থাকবে, যেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোটারেরা ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে।’
আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাওয়া বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আমি ১৯৭০ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। খোদ বঙ্গবন্ধু যখন চকরিয়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভা করেন, তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। ওইসময় আমি তাকে (বঙ্গবন্ধু) পায়ে ধরে সালাম করেছিলাম। মাঝপথে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে তখন হামলা, মামলা ও নানামুখি চাপের মুখে পড়ে বিএনপিতে যোগ দিতে বাধ্য হই। এখন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায়, তাই আবারো পুরোনো দলে ফিরে এসেছি।’
বিএনপি করাকালীন আপনি বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, তাছাড়া দলীয় মনোনয়ন পেলেও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ তৃণমূল নেতাকর্মীরা আপনার সঙ্গে নেই কেন? এমন প্রশ্ন করা হলে কামাল উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির জনক, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালী। অতএব তাকে নিয়ে যারা অপরাজনীতি করেন, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হবেন। তাই এই সময়ে এসে আবারো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে লালন করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছি, তাই দল আমাকে মনোনয়নও দিয়েছেন।’
বমু বিলছড়ি ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় চকরিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়ার। তিনি বলেন, ‘দল থেকে তাকে মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়টি আগে থেকে চুড়ান্তভাবে জানতে পারায় তিনি বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগের যোগ দিয়েছেন বলে শুনেছি। তবে দলের কাউকে কিছু না বলায় এখনো তিনি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কমিটিতেই রয়ে গেছেন। নির্বাচন শেষ হলে দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে চুড়ান্তভাবে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।’
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা সম্প্রতি চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘তৃণমূল থেকে প্রেরিত তালিকায় কামাল উদ্দিনের নাম থাকায় তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু তিনি যে বিএনপি করতেন তা আমি জানতাম না।’

পাঠকের মতামত: