ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজার জেলায় ৩০৯ কোটি টাকায় ৬২টি স্কুল নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম

মাহাবুবুর রহমান, কক্সবাজার ::  কক্সবাজার জেলায় ৩শত ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬২টি স্কুল নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম এবং কাজে ধীরগতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে ডিসেম্বর মাসে এসব স্কুল নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত কোন স্কুল নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। তার উপর প্রত্যেকটি স্কুল নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রি ব্যবহার করে যেনতেন ভাবে কাজ শেষ করছে বলে অভিযোগ করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবী অভিযোগ দিলেও কোন কাজ হয়না বরং কাজে ধীরগতি নেমে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অফিসের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার নির্মিত হচ্ছে বহুমুখি দূর্যোগ আশ্রয় কেন্দ্র প্রকল্প কাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। জেলার ৮ উপজেলায় ৬২টি স্কুল নির্মিত হবে যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৫ কোটি টাকা। আর এই কাজের ঠিকাদারী কাজ পেয়েছে ওয়াহিদ কন্সট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারিধারাবাহিকতায় কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৭টি স্কুল নির্মাণ হচ্ছে। এরমধ্যে শহরের উত্তর নুনিয়ারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের শেষে দিকে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো ২৫ ভাগ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। এতে ৩শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে উত্তর নুনিয়ারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফোরকান আরা বেগম জানান, স্কুল নির্মাণের কাজ চলাতে আমরা বর্তমানে একটি ঝুঁপড়ি ঘরে কোন মতে শ্রেনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি এখানে আলো-বাতাস থেকে শুরু করে লেখাপড়ার কোন ভাল পরিবেশ নেই। তাই খুব সমস্যার মধ্যে ক্লাস নিতে হচ্ছে। আর ৩ তলার নতুন আধুনিক স্কুল ভবন হওয়ার কথা থাকলেও এখনো ২৫ ভাগ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। আর কাজের মান খুবই নিম্নমানের। কাজের মান খারাপ বললে উল্টো কাজ না করে চলে যায়। পরে ২০/২৫ দিন পরে এসে কাজ ধরে। এতে সব রডে মরিচা ধরে যায় যা দিয়ে আবার কাজ করছে। আমি বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা প্রকৌশলী সহ অনেক কর্মকর্তাকে জানালেও কোন সুরাহা হয়নি।
এ ব্যাপারে স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য মঈন উদ্দিন বলেন, কাজ ফেলে রেখে অনেক দিন কোথায় গায়েব হয়ে যায় আবার মাঝে মধ্যে এসে কাজ ধরে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ৫ বছরেও স্কুলের কাজ শেষ হবে না। সরকার শিক্ষার মান ধরে রাখার জন্য বিশাল বাজেটে এসব কাজ করছে অথচ মাঠ পর্যায়ে অনিয়মে ভরপুর।
এদিকে ঈদগাঁও ইছাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালমা আক্তার বলেন, আমার স্কুলে ৩টি ছাদ হয়েছে তবে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ছাত্রছাত্রী নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছি। বিশেষ করে ছাত্রীদের নিয়ে বড় সমস্যা। কারণ বর্তমানে খুবই ঝুকিপূর্ণভাবে ক্লাস কার্যক্রম চালাচ্ছি। আমরাও অনেক চেস্টা করে কাজ শেষ করাতে পারিনি। আর কাজের মান ভাল নয় বলেও জানান তিনি।
পিএমখালী ডিকপাড়া এলাকার ইউপি সদস্য নুরুল হুদা বলেন, ডিকপাড়া স্কুল নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় সেখানকার অভিভাবকরা প্রায় সময় অভিযোগ দেয়। বিষয়টি আমরা উপজেলা সমন্বয় সভাতে তুলেছি। কিন্তু এখনো কোন কাজ হয়নি। এতে উক্ত স্কুল থেকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে অভিভাবকরা। আর পাশ্ববর্তি স্কুল না থাকায় অনেকে ঝরে পড়ছে। কাজের মানও খুবই নিম্নমানের বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, অনেক সময় কাজ চলাকালীন আমরা মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে তারা বলেন যেভাবে নির্দেশনা আছে সেভাবেই কাজ করছি। আসলে সত্যি কথা হচ্ছে সরকার উপর থেকে ঠিকই মানুষের উন্নয়নের জন্য দেয় কিন্তু সেটা জনগণ পর্যন্ত পৌঁছছে না।
এদিকে উখিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, উখিয়া উপজেলাতে ৭টি স্কুল নির্মাণ কাজ চলছে যার প্রতিটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। কিন্তু কাজে যে বিশাল অনিয়ম হচ্ছে সেটা আমরা উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকবার বলেছি। কিন্তু তারা সেগুলো কানেও তুলেননা। বরং প্রকল্প কাজের কর্মকর্তাদের সাথে প্রায় সময় গোপন বৈঠকে দেখা যায় প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদের।
কক্সবাজার দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর চকরিয়া নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান বাধা হচ্ছে দূর্নীতি। প্রত্যেকটি কাজে দূর্নীতির ছোঁয়া। বর্তমান সরকার সবক্ষেত্রে চেস্টা করছে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়তে কিন্তু মাঠ পর্যায়ের দূর্নীতির কারণে সেটা অনেকাংশে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ৬২টি স্কুলের চলমান নির্মাণ কাজ নিয়ে তথ্য বহুল কাগজপত্র দিলে আমরা এব্যাপারে খোঁজ-খবর নেব।
এ ব্যাপারে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তৌহিদ কন্সট্রাকশনের প্রকল্প কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আমরা আরো কিছুদিন মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছি এখন ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ আছে। আর ৬২টি স্কুলের মধ্যে বেশির ভাগই কাজ শেষ পর্যায়ে। আশা করছি সব কিছু সময় মত শেষ করতে পারবো। তবে কিছু জায়গায় একটু পিছিয়ে আছে এটাও সত্য।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)র সহকারী প্রকৌশলী সৈয়দ আলী হাসান বলেন, আমার জানা মতে ৬২টি স্কুল নির্মাণের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। কোথাও হয়তো স্থানীয় কিছু সমস্যার কারণে পিছিয়ে আছে। আর কেউ অনিয়ম দূর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ জানায়নি বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আনিছুর রহমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরো কিছুটা সময় বাড়ানো হয়েছে। আর কাজের মান নিয়ে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানায়নি। জানালে আমরা ব্যবস্থা নেব।

পাঠকের মতামত: