ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

দুর্নীতিতে জর্জরিত উখিয়া বঙ্গমাতা সরকারী মহিলা কলেজ

 উখিয়া সরকারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব মহিলা কলেজে

 বিশেষ প্রতিবেদক ::
“উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট” কক্সবাজারের উখিয়া বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব মহিলা কলেজ। এ প্রতিষ্ঠানের আগাগোড়া সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। কলেজের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও অর্থ তছরুপের একাধিক ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সচেতন মহল হতবাক হয়েছে। লাগামহীন দুর্নীতির কারণে দুর্নীতিদমন কমিশনে অভিযোগও দেন এলাকাবাসী।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রেরিত এক চিটিতে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী সহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও তহবিলের টাকা আত্নসাতের অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন চেয়েছে দুদক। দুদকের চিঠির প্রেক্ষিত জেলা প্রশাসক কার্যালয় ৬ নভেম্বর প্রেরিত এক চিঠির মাধ্যমে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়। কিন্ত তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়ার দুই মাস অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারণে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেননি।

এদিকে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজের নিয়ম -কানুন না মেনে নিজের ইচ্ছে মতো প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়েছেন অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী। বঙ্গমাতা কলেজের জাতীয়করণ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় ৭/১০/২০১৮ ইংরেজি। পরেরদিন ৮/১০/২০১৮ ইংরেজি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী ও প্রভাষক কাজী সাহাব উদ্দিন যৌথ স্বাক্ষরে সোনালী ব্যাংক উখিয়া শাখা, হিসাব নং ০৯০৯২৩৩০০৮৭৮৭ থেকে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর বার লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা, ৩ জুলাই আট লাখ চার হাজার, ৯ আগষ্ট সাত লাখ পঁচাশি হাজার টাকা আআত্নসাত করেন। একইভাবে পূবালী ব্যাংক উখিয়া (হিসাব নং- ১০১৬১০ ১০৮০১৪) থেকেও লাখ লাখ টাকা আত্নসাত করেছেন। ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তাদের ইচ্ছেমত হিসাব পরিচালনা করেন অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী ও কাজী সাহাব উদ্দিন।

শুধু তাই নয়, অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী নিজের খেয়ালখুশি মতো ১৪ জন শিক্ষক- কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন। যাদের নিয়োগ দিয়েছেন তাদের নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক- কর্মচারীর বিরুদ্ধে একই সাথে দুই প্রতিষ্ঠানে চাকরি, দ্বৈত এমপিও ভোগের অভিযোগও রয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, বৈধ নিয়োগ কমিটি ছাড়াই ভূয়া কমিটি সৃজন করে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার অনেক প্রভাষক যে বিষয়ে পড়ান, তার সে বিষয়ে জ্ঞান নেই। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে চার্জশিট ভূক্ত ফৌজদারি মামলার আসামীও রয়েছেন। ইসলাম শিক্ষার প্রভাষক মো: জাফর আলমের বিরুদ্ধে ৫ টি মামলার চার্জশিট হয়েছে। মামলাগুলো হল, সি,আর নং- ৯২/২০১৮, নারী নির্যাতন মামলা নং, ৫৬৪/২০১৬, জি,আর মামলা নং- ৩৪৬/২০১৬, জি, আর মামলা ন-৪০০/২০১২, জি,আর মামলা নং- ১৪৪/২০১৫ইং। অথচ চাকরি বিধি অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে চার্জশিট গৃহীত হলে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক ভাবে বহিষ্কার করতে হয়। কিন্ত অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী প্রভাব খাটিয়ে তাকে নিয়োগ দেন এবং ওই শিক্ষক বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। একইভাবে ইতিহাসের প্রভাষক শাহ আলমকে ২০০০ সালে নিয়োগ দেখানে হয়। অথচ তিনি ২০১০ সাল পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং আল-আছিয়া স্কুল এন্ড কলেজের ধর্মীয় শিক্ষক হিসাবে এমপিওভূক্ত ছিলেন। দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই সরকারি সুযোগসুবিধা নেন ওই শিক্ষক। পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক দেলোয়ার হোসেন বর্তমানে পেকুয়া উপজেলার একটি মাদ্রাসার এমপিও ভূক্ত শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন।

প্রভাষক শাহ আলমের মতোই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে সুযোগসুবিধা নেন প্রভাষক দেলোয়ার হোসেন। পৌরনীতি শিক্ষক সাহাব উদ্দিন এইচ এসসিতে তৃতীয় বিভাগ। নিয়োগ বিধি অনুযায়ী শিক্ষা জীবনে তৃতীয় বিভাগ থাকলে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওই ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারেনা। একই ভাবে অর্থনীতি প্রভাষক ছন্দা চৌধুরীও অনার্সে তৃতীয় বিভাগ।

শুধু তাই নয়, এই ছন্দা চৌধুরী কলেজে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে কক্সবাজার এয়ারপোর্ট পাবলিক হাইস্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। কক্সবাজার আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজেও ৫ বছর শিক্ষকতা করেন। তার পদত্যাগের পর আকতার কামালকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১০ সালে কলেজ এমপিওভূক্ত হলে অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পদত্যাগ পত্র গায়েব করে তাকে পুনরায় এমপিওভূক্ত করে নেন। ছন্দার মতোই যুক্তিবিদ্যা প্রভাষক নার্গিস সোলতানাও ২০০১ সালে পদত্যাগ করে উখিয়া গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে যোগদান করেন। ২০১০ সালে তাকেও বঙ্গমাতা কলেজে এমপিওভূক্ত করে নেয়া হয়।

গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম নুরুল ইসলাম চৌধুরী, কলেজের সাবেক সভাপতি, সাবেক সাংসদ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ও কক্সবাজার কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এনায়েতুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জীববিজ্ঞান প্রভাষক মৈত্রী প্রভা বড়ুয়াকে জালিয়াতি করে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০০ সালে এম নুরুল বশর ভূঁইয়াকে জীববিজ্ঞান প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার চাকরি বহাল থাকাবস্থায় অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ২০০৪ সালে মৈত্রী প্রভা বড়ুয়াকে একই পদে নিয়োগ দেন। একই কায়দায় সমাজ বিজ্ঞান প্রভাষক তাহমিনা খানম এইচ এস সি এবং মাস্টার্সে তৃতীয় বিভাগ।

এছাড়া এই প্রভাষক ২০০১ সালে পদত্যাগ করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। পরবর্তীতে কলেজ জাতীয়করণ হলে অধ্যক্ষকে ম্যানেজ করে আবারও ফিরে আসেন এবং এমপিওভূক্ত হন। বাংলা বিভাগের প্রভাষক হেলাল উদ্দিন চৌধুরীকেও অনিয়ম করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাংলার এই প্রভাষক এইচএসসিতে তৃতীয় বিভাগ। তাছাড়া কলেজে বাংলা বিভাগের মন্জুরী পদ আছে একটি। ওই পদে ২০০০ সালে মিলন বড়ুয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়।

২০০৪ সালে একই পদে হেলাল উদ্দিন চৌধুরীকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। অনুরুপভাবে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রনজিদ বড়ুয়া, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মুজিবুল আলম, সহকারী লাইব্রেরিয়ান নুরুল আমিনকে নিয়োগ কমিটি ছাড়াই জালিয়াতি করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের প্রত্যেকের নিয়োগ হয়েছে ভূয়া কমিটির মাধ্যমে। যার সত্যতা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। এছাড়া অফিস সহকারী অাবদুল করিম সংশ্লিষ্টদের সাক্ষর জালিয়াতি ও ভূয়া বিল ভাউচার করে লাখ লাখ টাকা আত্নসাত করেছেন।

এদিকে শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (কলেজ ৩) মো: হেলাল উদ্দিনকে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অদ্যাবধি তদন্ত প্রতিবেদন দেননি হেলাল উদ্দিন। এসব অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলার জন্য সাবেক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজী সাহাব উদ্দিনকে বার বার ফোন করা হয়। কিন্তু ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য জানা যায়নি। -তা.ই.প

পাঠকের মতামত: