ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ : উপকূলীয় ৯ জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত

অনলাইন ডেস্ক :: অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আজ শনিবার সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। মোংলা ও পায়রা বন্দরে দেয়া হয়েছে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। এছাড়া খুলনা ও বরিশালের ৯ জেলায় দেখানো হয়েছে ১০ নম্বর মহা বিপদ সংকেত। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানায় আবহাওয়া অধিদফতর।

চট্টগ্রামে দেয়া হয়েছে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। উপকূলে জলোচ্ছাসের আশঙ্কা আবহাওয়া অফিসের।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিভিন্ন স্থানে দমকা হাওয়াসহ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। বৈরি আবহাওয়ার কারণে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ। সেন্টমার্টিনে আটকা পড়েছেন অনেক পর্যটক।

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ শনিবার সকাল পর্যন্ত মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার আকারে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৫শ’ থেকে ৭’শ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে। এটি আরো ঘণীভূত হয়ে এগিয়ে আসতে পারে।

এটি বাংলাদেশ অংশে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া এবং ভারতে সাগরদ্বীপের মাঝখানে আছড়ে পড়তে পারে।

এ এলাকায় উভয় দেশের সুন্দরবন অবস্থিত। ফলে ‘সিডরের’ মতো এবারের ঘূর্ণিঝড়টিও সুন্দরবনের ওপর দিয়ে অতিক্রম করার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ‘বুলবুল’ দিক বদলাচ্ছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান জানান, ঘূর্ণিঝড়টি আজ সন্ধ্যার পর থেকে মাঝরাতের মধ্যে বাংলাদেশের খুলনা-বরিশাল অঞ্চলের ওপর আঘাত হানতে পারে।

এর একটি অংশ ভারতের সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তবে উপকূলে আঘাত হানার আগে কিছুটা দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের (বিএমডি বা বাংলাদেশ মেট্রোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট) বিজ্ঞানীরা বলেছেন, উপকূলের ১৯ জেলায় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবে। এর মধ্যে ১৩ জেলা বেশি ঝুঁকিতে।

ঝড়ের সঙ্গে উপকূলীয় জেলা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৭ ফুট উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর বিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে।

এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সারা দেশে নৌযান ও ফেরি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। সেন্টমার্টিনে সহস্রাধিক পর্যটক আটকা পড়েছেন। উপকূলে সতর্কতা বাড়াতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে আজকের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিত জেএসসি পরীক্ষা আগামী ১২ নভেম্বর একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে; আর জেডিসি পরীক্ষা নেয়া হবে ১৪ নভেম্বর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়ের এ তথ্য জানান।

এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আজকের অনার্স দ্বিতীয়বর্ষ ও এলএলবি পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ পরিচালক ফয়জুল করিম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, ঘূর্ণিঝড়কে চার ভাগে ভাগ করা হলে এর ডান পাশে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকে। এর সঙ্গে বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস থাকে। সবচেয়ে আতঙ্কের হয় যদি আঘাত হানার সময়ে সাগরে জোয়ার থাকে। তখন জলোচ্ছ্বাস বেড়ে যায়।

আর বুয়েটের পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বুলবুল’ এখন পর্যন্ত ক্যাটাগরি-২ পর্যায়ের ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আছে। এর প্রভাব পুরো দক্ষিণাঞ্চলসহ উত্তর-পশ্চিম এবং মধ্যাঞ্চলে পড়বে। তবে এটাও ঠিক যে, ঘূর্ণিঝড়ের সার্বিক ব্যাপারে এভাবে আগাম পূর্বাভাস করা কঠিন।

কেন না যে কোনো সময় এ ধরনের ঝড় গতিমুখ পরিবর্তন করতে পারে। সে কারণে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

বুলবুল এখনও সমুদ্রে থাকলেও স্থলভাগে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বুলবুলের কারণেই শুক্রবার দুপুর থেকে আকাশের মুখ ভার। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আকাশ ছিল ধূসর বর্ণের মেঘে ঢাকা।

দুপুরের পর ঢাকাসহ উপকূলীয় এলাকায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়। আর উপকূলবর্তী এলাকায় বুলবুলের প্রভাব আরও বেশি হবে। ইতিমধ্যেই দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বেড়েছে সমুদ্রে ঢেউয়ের উচ্চতাও।

বিএমডি জানায়, শুক্রবার রাত ৯টায় ঘূর্ণিঝড়টির অবস্থান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৫৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৫৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ১০০ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ভয়াবহতা ও ছোবল থেকে জনগণের জানমাল রক্ষায় সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

আপাতত এর গতিমুখ সুন্দরবনের দিকে। তবে এতে ফসল ছাড়া বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা নেই। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতটি উপকূলীয় জেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দেশের ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত আছে। ঝড়ের ১৪ ঘণ্টা আগে লোকজন সরিয়ে নেয়া হবে। তবে এ ব্যাপারে আজ বেলা ১১টায় সচিবালয়ে প্রস্তুতি সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামালসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। সাত জেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে লোক সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি আছে।

আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় ২০০০ প্যাকেট করে শুকনো খাবার পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও জেলা-উপজেলা সংশ্লিষ্টদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

জানা গেছে, শুক্রবার চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক ছিল। তবে বহির্নোঙরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে এসে মোংলা বন্দরে পণ্য ওঠানামা একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়।

সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড় ‘মাতমো’ গত অক্টোবরের শেষে ভিয়েতনাম হয়ে স্থলভাগে উঠে আসে। সেই ঘূর্ণিবায়ুর অবশিষ্টাংশই ইন্দোনেশিয়া পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে এসে প্রথমে লঘুচাপে ও পরে তা ৬ নভেম্বর নিুচাপে রূপ নেয়। এরপর এখন তা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলে’ রূপ নিল।

এর আগে গত ৩ মে উড়িষ্যায় আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় ফণী। সেটি পরদিন বাংলাদেশে দুর্বল হয়ে আঘাত হেনেছিল।

পাঠকের মতামত: