ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

শিশু চুরি তাঁদের ‘পেশা’

প্রতিটি শিশু চুরি করে ওঁরা আয় করেন এক থেকে দেড় লাখ টাকা! 

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ::  নিঃসন্তান অনেক দম্পতি একটি শিশুর জন্য আকুতি জানান। ছোট শিশুকে দত্তক হিসেবে এনে দিতে পারলে দেন ভালো বখশিশ। আর এমন ‘দত্তক-বখশিশ’-কে পুঁজি করে শিশু চুরি করে কথিত দত্তক দেওয়াকে পেশা বানিয়ে ফেলেছে একটি চক্র। তাঁরা কৌশলে শিশু চুরি করে, এর পর শিশুর মা ডেলিভারির সময় মারা গেছেন-এমন ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেন। পরে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে ওই শিশুকে দত্তক হিসেবে দেন বা বিক্রি করে দেন। প্রতিটি শিশু চুরি করে ওই চক্র আয় করে এক থেকে দেড় লাখ টাকা।

এভাবে একটি দুটি নয়, অন্তত ১২টি শিশু চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে চক্রটি। শেষ পর্যন্ত এক ভিক্ষুকের শিশু চুরির ঘটনায় ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। ফাঁস হয় নগরে শিশু চুরি এবং কথিত দত্তক দেওয়ার নেপথ্য কাহিনি। কোতোয়ালী থানা পুলিশ শিশু চোর চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে। একই সঙ্গে চুরি করে নিয়ে যাওয়া শিশুকে উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহসিন জানান, শেফালী বেগম নামের এক নারী ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত ২৬ মে নগরীর কাজির দেউড়ি এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তির সময় অজ্ঞাতনামা এক যুবক তাঁর শিশুকে কাপড় কিনে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পরদিন ওই ব্যক্তি শেফালীকে নিয়ে কাপড় কেনার জন্য তিনপুলের মাথা এলাকায় যায়। শেফালীর সঙ্গে ছিল দুই মাস বয়সী সন্তান মোহাম্মদ আলী।

ওই দিন চৈতন্যগলির একটি হোটেলে শেফালীকে নাস্তা খাওয়ানোর পর ১০০ টাকা দামের জামা কিনে দেয় ওই যুবক। পরক্ষণে হোটেলে ছফিনার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শেফালী বমি করেন। বমির পর শেফালীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য বাথরুমে যেতে বলেন। তখন শেফালী নিজের সন্তান ওই যুবকের কোলে দিয়ে বাথরুমে যান। কিছুক্ষণ পর বাথরুম থেকে ফিরে শেফালী দেখেন নির্দিষ্ট স্থানে ওই যুবক নেই। সঙ্গে নিয়ে যায় তাঁর সন্তানকেও। ঘটনার পরদিন ২৮ মে অজ্ঞাতনামা যুবকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন শেফালী বেগম। মামলার পর বাচ্চা উদ্ধারে তৎপর হয় কোতোয়ালী থানা পুলিশ। সেই ধারাবাহিকতায় চোর চক্র শনাক্ত, গ্রেপ্তার এবং বাচ্চা উদ্ধার করে গতকাল রবিবার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, শিশু চুরির প্রায় ছয় মাস পর মায়ের কোলে ফিরল শিশু মোহাম্মদ আলী।

উদ্ধার হওয়া শিশু মোহাম্মদ আলীর বিষয়ে ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘কক্সবাজার এবং নগরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর তারা মোহাম্মদ আলীর সন্ধান দেয়। তারপর দামপাড়া পল্টন রোডের একটি বাসা থেকে মোহাম্মদ আলীকে উদ্ধার করা হয়।’

চক্রের তিন সদস্য হলেন সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের হাঙরমুখ এলাকার মো. আফসার ওরফে জাফর সাদেক (৩৫), লোহাগাড়া উপজেলার সেনেরহাট এলাকার আবুল বশরের স্ত্রী পারভীন আক্তার (৩০) এবং পটিয়া উপজেলার পশ্চিম গৈড়লা গ্রামের অনন্ত মোহন নাথের ছেলে সুজিত কুমার নাথ (৪৫)।

গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘আসামি আফসার প্রায় এক যুগ আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেটের বেসিক ল্যাবে চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, আয়াসহ নানা পদের কর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয়। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা অনেক নিঃসন্তান দম্পতি বাচ্চা দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাচ্চা দত্তকের ব্যবস্থা করতে পারলে ওই দম্পতি বখশিশ দেওয়ার কথাও বলেন।’

বাচ্চা দত্তকের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে মোট অঙ্কের বখশিশ পাওয়ার লোভে পড়ে আফসার নগর ও জেলার রাস্তাঘাটে ঘুরে এমন পথশিশু, হতদরিদ্র কিংবা ভিক্ষুকদের দুই মাস থেকে ছয় মাস বয়সী শিশুদের চুরির টার্গেট করে। টার্গেটকৃত শিশু কৌশলে চুরির পর আসামি পারভীন আকতারের হেফাজতে রাখা হয়। ওই শিশু পারভীন আক্তারের হেফাজতে রেখে নিঃসন্তান দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন আসামি সুজিত কুমার নাথ। এরই মধ্যে ওই শিশুর মা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এমন ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেন আসামিরা। এর পর নিঃসন্তান দম্পতির কাছে শিশুকে হস্তান্তর করেন। আর যে দম্পতি শিশুটি গ্রহণ করেন, তাঁরা হাসপাতালের মৃত্যুর সনদ থেকে বিশ্বাস করেন ওই শিশুর মা মারা গেছেন। পরবর্তীতে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে শিশুকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন নিঃসন্তান দম্পতি।-এমন প্রক্রিয়ায় এই পর্যন্ত অন্তত ১২ জন শিশু চুরির সঙ্গে আসামিরা জড়িত বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন আসামিরা।

পাঠকের মতামত: