ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

এনজিও সংস্থা পালস্ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ::
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিবন্ধনে ‘পালস বাংলাদেশ’ লেখা থাকলেও জয়েন্ট স্টকের নিবন্ধনপত্রে রয়েছে শুধুমাত্র ‘পাল্স’। জয়েন্ট স্টকের নিবন্ধনে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির অস্থিত্ব নেই। এছাড়াও এনজিও ব্যুরোর যে নিবন্ধন সনদ তাদের রয়েছে সেটিও জালিয়াতিতে ভরা। এই জাল সনদ ব্যবহার করে এনজিও ব্যুরো, ডিসি অফিস সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে বছরের পর বছর বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নিবন্ধনবিহীন এনজিও সংস্থা ‘পালস বাংলাদেশ’।
পাল্স বাংলাদেশ এনজিও’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শিবির কেন্দ্রিক দীর্ঘদিন ধরে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ আছে। এই সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গা শিবিরে টানা তিন বছর ধরে কাজ করেছে মিয়ানমার ভিত্তিক এনজিও সংস্থা কমিউনিটি পার্টনার ইন্টারনাশ্যনাল (সিপিআই)। সিপিআই মানবিক সংকটে লোক দেখানো কাজ করলেও তাদের মূল মিশন ছিল মিয়ানমার গোয়েন্দা সংস্থার গুপ্তচরবৃত্তি করা। সেই হিসেবে শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মিয়ানমারের কাছে পাচার করে এসেছিল সিপিআই। লস্করে তৈয়বার অর্থায়নে এফআইএফ বা সন্দেহভাজন পিপলস ইন নিড (পিন) এনজিও সংস্থাটিও পালস বাংলাদেশের মাধ্যমে এদেশে এসেছে এবং রোহিঙ্গা শিবিরে মিশন বাস্তবায়ন করছে। এরকম আরও অনেক অনুমোদনহীন বিদেশি এনজিও পালস বাংলাদেশের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শিবিরে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালিত সিপিআই এবং অন্য একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালিত পিন এনজিও’র সাথে কাজ করার কথা স্বীকারও করেছেন পালস বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিম। এ দুটি সংস্থার সাথে কাজ করার মধ্যে কোন অন্যায় খোঁজে পান না তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতারণার মধ্য দিয়ে কথিত এনজিও সংস্থা ‘পালস বাংলাদেশের’ যাত্রা শুরু হয়েছিল। অন্য একটি সংগঠনের নিবন্ধন নাম্বার নকল এবং জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করার অপরাধে ২০১১ সালে পালস বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছিল। ওই তদন্তে জালিয়াতি ধরা পড়ায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর পালস বাংলাদেশ এর নিবন্ধন বাতিল করে। কিন্তু এরপরও থামেননি তাদের। প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে অনুমোদন ছাড়া বিদেশি অর্থ এনে আত্মসাৎ করেছেন বছরের পর বছর।
২০১৭ সালে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। নতুন করে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার সুযোগে ভাগ্য খুলে যায় পালস বাংলাদেশ এর। স্থানীয় এই এনজিও’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ‘ম্যানেজ’ করে কোটি কোটি টাকা বিদেশি ডোনেশন এনেছে। বিশেষ করে উগ্রবাদ ছড়ায় এমন বিতর্কিত বিদেশি এনজিওগুলোকে অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশে ঢুকতে সহায়তা করে পালস বাংলাদেশ। সেই সুবাধে হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায় সংস্থাটি। পালস বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাবমতে, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার বিদেশি ফান্ড এনেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। কাগজেপত্রে অর্ধশত কোটি টাকা হলেও অবৈধ উপায়ে আসা ফান্ডের হিসাব করলে এ অর্থ শত কোটিতে দাঁড়াবে। অভিযোগ রয়েছে বেশির ভাগ লুটপাট করেছে সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা।
যে ‘পাল্স বাংলাদেশ’ এর নামে বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা রোহিঙ্গা সংকটে ব্যয়ের জন্য এসেছে সেই পালস বাংলাদেশ সংস্থাটি সম্পূর্ণ অনুমোদনবিহীন। বাংলাদেশ সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং জয়েন্ট স্টকের নিবন্ধনে কোথাও ‘পালস বাংলাদেশ’ নামে কোন এনজিও সংস্থার অস্থিত্ব নেই। এক সংস্থার দেয়া সার্টিফিকের সাথে অন্য সংস্থার সার্টিফিকের নামের এবং তারিখের কোন মিল নেই। কিন্তু তারপরও এফডি-৭ এর অনুমোদন নিয়ে ৪০ টির অধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি। বর্তমানেও করে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, জাল সনদে কিভাবে এফডি-৭ অনুমোদন পেল পালস বাংলাদেশ। নাকি এই এনজিও’র অপতৎপরতার সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অসাধু কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে?
এনজিও’র এ সংক্রান্ত আইনে উল্লেখ আছে, সমাজসেবামূলক কাজ করার জন্য স্থানীয়ভাবে সমাজসেবা কার্যালয়ের নিবন্ধন প্রয়োজন হয়। কিন্তু পালস বাংলাদেশ সরকারের এই দপ্তরের কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে ২০১১ সালে। সেই সুবাধে সমাজসেবার নিবন্ধন ভবিষ্যতেও পাবে না এই সংস্থা। স্থানীয় এনজিও’র ক্ষেত্রে স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের নিবন্ধন ছাড়া বিদেশি অর্থ সহায়তা দেশে আনার জন্য এনজিও ব্যুরো অনুমোদন দেয় না। কিন্তু স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের নিবন্ধন ছাড়া ২০১৮ সালের শুরুতে এনজিও ব্যুরো রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করার জন্য এফডি-৭ অনুমোদন দেয় পালস বাংলাদেশকে। এই ধরণের একটি অনুমতিপত্রের কপি এ প্রতিবেদকের কাছে উপস্থাপনও করেছে পালস বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
পালস বাংলাদেশের পরিচালক (প্রোগাম) আতিক উদ্দিন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় অথরিটি হিসেবে তারা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়েছে। এছাড়া জয়েন্ট স্টকের নিবন্ধনও রয়েছে তাদের। যুব উন্নয়নের নিবন্ধনের প্রেক্ষিতে এনজিও ব্যুরো তাদেরকে সম্প্রতি ১০ বছর মেয়াদে নিবন্ধন দিয়েছে।
পালস এর পরিচালক আতিক উদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যে সনদ রয়েছে সেখানে সংস্থার নাম উল্লেখ আছে বাংলায় ‘পালস বাংলাদেশ’ হিসেবে। এই সনদের প্রেক্ষিতে এনজিও ব্যুরো নিবন্ধন দিয়ে থাকলে তাদের নিবন্ধনপত্রে ‘পালস বাংলাদেশ’ লেখা থাকার কথা। কিন্তু এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধনপত্রে লেখা রয়েছে ‘পালস সোসাইটি’ নামে। এছাড়াও অনুমোদনের স্থলে ‘৬ জুন ২০১৯ সাল’ উল্লেখ থাকার কথা থাকলেও উল্লেখ রয়েছে ‘৬ জুন ১৯৯৪ সাল’। অথচ ১৯৯৪ সালে এই এনজিও সংস্থার অস্থিত্বই ছিল না। একইভাবে জয়েন্ট স্টকের অনুমোদনপত্রেও ‘পালস বাংলাদেশ’ নামের পরিবর্তে উল্লেখ আছে শুধুমাত্র ‘পালস সোসাইটি’। অথচ জেলা প্রশাসকের এনজিও সেল এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনে তাদের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘পালস বাংলাদেশ’ হিসেবে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সফি উদ্দিন বলেন, ২০১১ সালে আরেকটি এনজিও’র নিবন্ধন নাম্বার চুরি এবং স্বাক্ষর জাল করার অপরাধে পালস বাংলাদেশ নামে এনজিওটিকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বাতিল করা হয়। এরপর থেকে আর অনুমোদন দেয়া হয়নি। এই এনজিও’র বর্তমানে সমাজসেবা কার্যালয়ের নিবন্ধন নেই।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে বা অন্যকোথাও কাজ করার ক্ষেত্রে প্রথমে স্থানীয়ভাবে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের নিবন্ধনভুক্ত হতে হয়। সমাজসেবা কার্যালয়ের নিবন্ধনের উপর ভিত্তি করে এনজিও ব্যুরো নিবন্ধন দিয়ে থাকে। যেহেতু সমাজসেবার নিবন্ধন নেই তাহলে বুঝতে হবে নিশ্চয় কোন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিদেশি অর্থ সহায়তা এনে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানান তিনি।
নাগরিক আন্দোলনের নেতা এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই পালস বাংলাদেশ এনজিও’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকান্ডসহ নানা অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ আছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোন সময় প্রশাসন বিন্দু পরিমাণ অ্যাকশন নেয়নি। এই এনজিও’র যে কোন নিবন্ধন নেই সেটি জেনে রীতিমত অবাক হচ্ছি। কিভাবে প্রশাসনের এতগুলো দপ্তরের সাথে জালিয়াতি করতে পারে। তিনি দ্রুত তদন্ত করে এই এনজিও’র বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানান।
এদিকে পালস বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিম সংস্থাটির বর্তমানে প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় বিজিবি ক্যাম্প এলাকায়। তাঁর দাবী, সরকারি সকল নিয়ম-কানুন মেনেই তারা কর্মকান্ড চালাচ্ছেন। সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিম বলেন, ‘এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন পাওয়ার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ের নিবন্ধন অত্যাবশ্যক নয়। স্থানীয় হিসেবে আমাদের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিবন্ধন রয়েছে।’
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সনদের সাথে এনজিও ব্যুরোর সনদের নামের গরমিল থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তার সংস্থার নিয়মিত অডিট হয় বলে দাবী করেন তিনি। পালস এর জালিয়াতির তথ্য পাওয়ার পরে তদন্ত কমিটি করে এনজিওটির বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এতদিন নজরে আসেনি। এখন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এনজিও ব্যুরোতে চিঠি লেখা হবে। একই সাথে স্থানীয়ভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দৈনিক কক্সবাজার

পাঠকের মতামত: