ঢাকা,মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪

কক্সবাজার সৈকতের সবুজ বেষ্টনী ভাঙনের কবলে, তিন সপ্তাহে বিলীন ৫ হাজার ঝাউগাছ

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ::  বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সবুজ বেষ্টনী ঝাউবাগান এখন সাগরের ভাঙনের কবলে পড়েছে। সৈকতের ভাঙনে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার ঝাউগাছ। এতে নষ্ট হচ্ছে সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য। সর্বশেষ গত তিন সপ্তাহে প্রবল বর্ষণ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজার সমিতিপাড়া থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত সৈকতের সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার ঝাউগাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। এমনকি গত সাড়ে চার দশকে আট লাখেরও বেশি ঝাউগাছ ভাঙন ও নিধনের কবলে পড়েছে।
এদিকে গত ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়ও ঝাউবন রক্ষা ও আরো বাগান সৃজনের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। তবে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে ডায়বেটিক পয়েন্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ মিটার স্থানে জিও টিউব বসিয়ে (বালির টিউব) ঝাউগাছ রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ১২০ কিলোমিটার সৈকতের বিভিন্নস্থানে সবুজ বেষ্টনির মত দাঁড়িয়ে আছে ঝাউগাছ। সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি পর্যটকদের অসাধারণ সৌন্দর্যের হাতছানি দিচ্ছে এ ঝাউ বাগান। কিন্তু সাগরের ভাঙনে শহরের নাজিরারটেক, চরপাড়া, সমিতিপাড়া, ডায়বেটিক হাসপাতাল, শৈবাল পয়েন্ট থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত ঝাউ বাগানে নেমে এসেছে মহাবিপর্যয়। গত দুই বছরে শুধুমাত্র এসব এলাকায় বিলীন হয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার গাছ। এছাড়াও পর্যটন স্পট হিমছড়ি, প্যাঁচারদ্বীপ, ইনানীসহ টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে ভাঙন, নিধন ও দখলের কবলে পড়েছে ঝাউবাগান।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২-৭৩ সালে কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়িতে ৪৮৫ হেক্টর এলাকাজুড়ে ঝাউবাগান সৃজন করা হয়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যায়ক্রমে ২০১৮-১৯ অর্থ বছর পর্যন্ত ৫৮৫ হেক্টর এলাকাজুড়ে প্রায় সাড়ে আট লাখ ঝাউগাছ সৃজন করা হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈকতজুড়ে প্রায় সাড়ে আট লাখ চারা রোপন করা হলেও সৈকতের ভাঙন ও নিধনে বর্তমানে ঝাউগাছের সংখ্যা ২০ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন বন বিভাগও। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর জানান, যেখানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে অবস্থানগত কারণে হয়তো সেইসব স্থানে নতুন চারা লাগানো যাবে না। তবে আগামী তিন বছরে ১৪০ হেক্টর এলাকাজুড়ে খালি জায়গায় আরো এক লাখ চারা রোপন করা হবে বলে জানান তিনি।
সমিতি পাড়ার বাসিন্দা ও প্রাইমারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সাবেক সুপার মো. নাছির উদ্দিন চকরিয়া নিউজকে বলেন, আশির দশকের পর থেকে সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। বর্ষায় ভাঙন আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে নাজিরারটেক থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত অব্যাহত ভাঙনে গত দুই বছরে স্থানভেদে এক কিলোমিটারেরও বেশি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, অন্যদিকে ঝাউবাগানের কিছু কিছু অংশে অবৈধ বসতি গড়ে তোলায় দিন দিন সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম এ সমুদ্র সৈকত।
কক্সবাজারের পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ সেন বাঞ্চু বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় পানি ওভারফ্লো হচ্ছে। সৈকতে পর্যটকদের অবাধ বিচরণ ও কিছু অসাধু লোকজন সৈকত থেকে লতাপাতা কেটে নিয়ে যাওয়ার কারণে সৈকতের বালিয়াড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারা বলেন, সমুদ্র সৈকতে বালিয়াড়িগুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখে সৈকত লতা, নিশিন্দাসহ গুল্ম জাতীয় লতা বা ঝোপগুলো। কিন্তু দিন দিন এসব লতা পাতা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় সৈকতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এতে একদিকে সৈকতের সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে সাগর লোকালয়ের দিকে চলে যাওয়ায় কমে আসছে ভুখণ্ড। এছাড়াও স্বাভাবিক সৈকত না থাকায় সামুদ্রিক কচ্ছপ, লাল কাঁকড়াসহ এধরনের প্রাণীগুলো আবাসস্থল হারাচ্ছে। ফলে ঝুঁকির মুখে পড়ছে জীব বৈচিত্র্য।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আবসার চকরিয়া নিউজকে বলেন, একদিকে সাগরের ভাঙন অন্যদিকে কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে সৈকতের ঝাউ বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ভাঙন ঠেকাতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আর যারা ঝাউ বাগানে অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছে এবং যারা গাছ নিধন করছে তাদের উপর নজরদারি বাড়ানো হবো। প্রয়োজনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঝাউবন রক্ষায় জিওটিউবের বালির বাঁধ : কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, লাবণী পয়েন্ট থেকে ডায়বেটিক পয়েন্ট পর্যন্ত ১হাজার ৪০০ মিটার এলাকা জুড়ে সৈকতের ঝাউবাগানের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে জিওটিউব দিয়ে বালির বাঁধ দেয়া হচ্ছে। প্রতি ২০ মিটারে একটি টিউব বসানো হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ছয়টি টিউব বসানো হয়েছে। আশা করছি, এমাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা যাবে। তিনি জানান, প্রায় ৮৪ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছেন জেলা আওয়ামী লীগ নেতার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। দ্রুত কাজ শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হলেও জোয়ারের পানির ঢেউয়ে কাজের ব্যাঘাত ঘটছে। যে কারণে দিনের পুরোটা সময় কাজ করাও যাচ্ছে না বলে জানান তনয় কুমার ত্রিপুরা।

পাঠকের মতামত: