ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

আ.লীগ-ঐক্যফ্রন্ট সংলাপ আজ, সবার চোখ গণভবনে

ডেস্ক নিউজ :   নতুন নতুন রাজনৈতিক জোটগঠন ও আন্দোলন-মিছিল-সভা-সমাবেশের ভেতর হঠাৎ করেই সংলাপকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন মোড়ের সৃষ্টি। নানা ধরনের শঙ্কা-অনিশ্চয়তার মধ্যেও রাজনীতির মাঠের শেষপ্রান্তে যেন আলোকবিন্দু দেখা যাচ্ছে। সফলতা নিয়ে তর্কবির্তক ও শঙ্কা থাকলেও বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে একটি সম্ভাবনার পথ তৈরি হয়েছে। আর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যের সংলাপের আহ্বানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ায়। যে কারণে দেশবাসী তাকিয়ে রয়েছে বহুল প্রত্যাশিত সংলাপের দিকে। আজ বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সবার নজর থাকছে গণভবনের দিকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা প্রধানমন্ত্রীর এই সংলাপের উদ্যোগকে দেশের রাজনীতির জন্য সুবাতাস বলে মনে করছেন। তাদের মতে, এই উদ্যোগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের এককাতারে আনতে সফল হয়েছে। এই সংলাপ দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে বলেও তারা মনে করেন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি একাধিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারার সঙ্গে শুক্রবার (২ নভেম্বর) ও সোমবার (৫ নভেম্বর) বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপের সময় নির্ধারণ হয়েছে। এছাড়া সরকার বা দলগুলোর প্রত্যাশ্যায় আরও একাধিক দলের সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘শুধু ঐক্যফ্রন্ট বা যুক্তফ্রন্ট নয়, প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য দলের সঙ্গেও সংলাপে বসতে রাজি। তবে, সময় একটি ব্যাপার, শিডিউলের বিষয় আছে। এর মধ্যেই সংলাপ করতে হবে।’

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নীতি-আদর্শের দিক থেকে আগাগোড়াই মতপার্থক্যে থাকা কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার পরপরই দ্রুত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে থাকে। যার ধারাবাহিকতায় গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় তা সরকারের সঙ্গে সংলাপে নিয়ে গেছে। অথচ গত দুই বছর ধরে বিএনপি বরাবর সরকারের সঙ্গে সংলাপের দাবি জানিয়ে এলেও তা নাকচ হয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে এসেছে। অবশ্য ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেন থাকায় যতটা সহজ হয়েছে, বিএনপির সঙ্গে বা দলটির কারও নেতৃত্বে হলে এতটা সহজ হতো না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

দুই পক্ষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এলে সংলাপে ভালো কিছু হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংলাপ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা সুবাতাসের দোলা। তবে সংশয় হচ্ছে, এই বাতাসটি কতক্ষণ বহমান থাকবে? কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের সংলাপের সফলতার কথা বলে না। তবে, আমাদের প্রত্যাশা সংলাপ সফল হবে, দেশে নির্বাচনমুখী পরিবেশ হবে।’

এই সংলাপকে ইতিবাচক বলে মনে করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সংলাপের ফলে দুটি দলের মধ্যকার দূরত্ব কিছুটা কমবে। দুই পক্ষের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছাপিয়ে সংলাপ আশার আলো দেখাচ্ছে।’ সংলাপে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বে থাকায় সহজ হয়েছে বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। বিএনপি সরাসরি এলে সংলাপটি এত সহজ হতো বলে তার ধারণা।

এই সংলাপ দেশের অস্থিরতা নিরসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। তিনি বলেন, ‘ভালো কিছু প্রত্যাশার জন্য দুই পক্ষকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সংলাপে গিয়ে স্বার্থের বিষয়ে গোঁ ধরে থাকলে চলবে না।’

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সংলাপের তথ্যটি আমাদের জন্য খুবই ইতিবাচক সংবাদ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংলাপেই বড় ধরনের কিছু আশা করাটা কঠিন।’

সংলাপে ‍দুই দলের প্রতিনিধি

বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন—বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস; নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না ও এসএম আকরাম; গণফোরামের মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী; জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল মালেক রতন ও তানিয়া রব; ঐক্যপ্রক্রিয়া থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আ ব ম মোস্তফা আমিন। আরও থাকছেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সংলাপে নেতৃত্ব দেবেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের ২১ সদস্যের প্রতিনিধিদের মধ্যে দলের বাইরে দলটির শরিক ১৪ দলীয় জোটের তিন নেতাও রয়েছেন। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন—আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফরউল্লাহ, ওবায়দুল কাদের, আবদুল মতিন খসরু, ড. আব্দুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, আনিসুল হক, মাহবুবউল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, ড. হাছান মাহমুদ, ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ ও শ. ম. রেজাউল করিম এবং শরিকদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, মইন উদ্দীন খান বাদল ও দিলীপ বড়ুয়া।

প্রসঙ্গত, সাত দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্যের ভিত্তিতে সংলাপের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ড. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি দেয় ঐক্যফ্রন্ট। এর পরদিন আওয়ামী লীগ সংলাপে সম্মতির কথা জানায়। একইসঙ্গে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সময় নির্ধারণ করে ২৯ অক্টোবর সকালে ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেনের বাসায় চিঠি পৌঁছে আওয়ামী লীগ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংলাপের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর সফলতা নেই বললেই চলে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি, এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৪ সালের এপ্রিল ও ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর সংলাপের উদ্যোগ হলেও এর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথের তৎকালীন মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা ও তার বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানের মধ্যস্থতায় সংলাপ হলেও ওই সময়ের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। এছাড়া ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল তিন সপ্তাহব্যাপী ছয় দফা বৈঠক করলেও সমঝোতা হয়নি। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্বাচন নিয়ে সংকট নিরসনে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে সরাসরি ফোন দিয়ে সংলাপের আমন্ত্রণ জানালে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে দেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

পাঠকের মতামত: