ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

আমাদের বাঁচান !

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামার লক্ষণঝিরি হতে ফিরে ::

ভূমিদস্যুদের হিংস্র থাবায় ৪ পুরুষের বসতভিটা হারাতে বসেছে বান্দরবানের লামার দুর্গম লক্ষণঝিরি ম্রো পাড়াবাসি। একইসাথে পাশ্ববর্তী আরো ৮টি ম্রো ও ১টি মার্মা পাড়ার ১৬১ পরিবারের ভোগদখলীয় অধিকাংশ জায়গা ভূমিদস্যুরা জবরদখল করে নিয়েছে বলে জানায় স্থানীয়রা। লক্ষণঝিরি ম্রো পাড়া সহ অন্যান্য উপজাতি পাড়াগুলো লামার সদর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পোপা মৌজার দুর্গম এলাকায় অবস্থিত।

সরেজমিনে দেখা যায়, লক্ষণঝিরি ম্রো পাড়াটির চারপাশে জঙ্গল কেটে পরিস্কার করে দখল নিয়েছে স্থানীয় ভূমিদস্যু রবিউল হোসেন ভূঁইয়ার (সভাপতি, লামা ইউনিয়ন বিএনপি) সহযোগিতায় কামাল উদ্দিন (পরিচালক, লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ, সরই), শফিক উদ্দিন আহমদ (মোস্তফা গ্রুপ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম)। সরেজমিনে গেলে রবিউল হোসেন ভূঁইয়ার নির্দেশে বেশ কয়েকজন শ্রমিক জঙ্গল পরিস্কার করতে দেখা যায়। কর্মরত শ্রমিকরা জানায়, লক্ষণঝিরি ম্রো পাড়া হতে তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে লাইল্যা ম্রো পাড়া পর্যন্ত পাহাড়ের জঙ্গল কাটতে তাদের বলা হয়েছে। বিস্তৃর্ণ এই এলাকাটি উল্লেখিত দখলদার সিন্ডিকেট তাদের বলে দাবী করছে।

লক্ষণঝিরি ম্রো পাড়ার ১১ পরিবার সহ বেদখল হতে শুরু হওয়া অন্যান্য পাড়া গুলো হল, লাইল্যা ম্রো পাড়া (১৮ পরিবার), লাইল্যা নতুন ম্রো পাড়া (২২ পরিবার), পানসি ম্রো পাড়া (২৪ পরিবার), খ্রিস্টান পাড়া (১২ পরিবার), পুরাতন তাই পাড়া (৩২ পরিবার), নতুন তাউ পাড়া (২৫ পরিবার), কালু ম্রো পাড়া (৭ পরিবার), লংআন পাড়া (৮ পরিবার) ও ডলু মার্মা পাড়া (১০ পরিবার)। মোট ১০টি পাড়ার ১৬৯ পরিবার এই ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের জবরদখলে সর্বশান্ত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

লক্ষণঝিরি ম্রো পাড়ার কারবারী মাংক্রাত ম্রো বলেন, চারপাশ ইতিমধ্যে দখল করে নিয়েছে রবিউল হোসেন ভূঁইয়া। আমাদের হাঁটাচলা পথ, জুমের জায়গা, গবাদি পশুপাখি চড়ার চারণভূমি, বাগান ও ফসলের ক্ষেত এখন ভূমিদস্যুদের দখলে। এইভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিন পরে কোন কাজকর্ম করতে না পেরে এমনিতে এই এলাকা ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে। আমাদের বাঁচান !

একই পাড়ার বাসিন্দা তনতুই ম্রো, স্টিফেন ম্রো, মাংখাই ম্রো জানান, বনায়নের নামে দুর্গম পোপা মৌজার পশ্চাৎপদ ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রায় ২শত বছরের দখলীয় ৫শত একরের অধিক আবাদকৃত জায়গা অবৈধ দখল করে নেয়া হয়েছে। আমরা ম্রো জনগণ বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে গত সোমবার (১ অক্টোবর) বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। মেনচিং ম্রো বলেন, আমাদের অত্র এলাকা হতে চলে যেতে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। লামা সদর ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি ভূমিদস্যু রবিউল হোসেন ভূঁইয়া পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে তাদের দ্বারা আমাদের হুমকি দিচ্ছে।

পোপা লক্ষনঝিরি ম্রো পাড়ার বাসিন্দা ম্রাথোয়াই ম্রো বলেন, আমরা উক্ত জায়গায় বহুকাল ধরে বসবাস করে আসছে। স্থানীয় ভূমিদস্যু রবিউল হোসেন ভূঁইয়া (সভাপতি, লামা ইউনিয়ন বিএনপি), কামাল উদ্দিন (পরিচালক, লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ, সরই), শফিক উদ্দিন আহমদ (মোস্তফা গ্রুপ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম), স্থানীয় বলিয়ারচর গ্রামের মো. ইউসুফ, তাউ পাড়ার বাসিন্দা হ্লাচিংঅং ম্রো ও লাই রো ম্রো সহ আরো ১০/১৫ জন সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদের পোপা মৌজার লক্ষনঝিরি মুরুং পাড়ার দখলীয়, আবাদী ও বন্দোবস্তীকৃত শত শত একর সৃজনশীল জুমের বাগান ও বনায়ন জবরদখল করছে। পোপা মৌজার হেডম্যান যোহন ম্রো সহায়তা করছে।

স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার আবুল কাসেম ও স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস ছাত্তার বলেন, এছাড়াও রবিউল হোসেন ভূঁইয়া পোপা মৌজার কলার ঝিরি এলাকায় প্রায় ৭শত একর, ঠাকুরঝিরি এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৩শত একর ও লক্ষণঝিরি এলাকায় ২৫০ একর জায়গা আগে থেকে তার দখলে রয়েছে। রবিউল হোসেন ভূঁইয়া কারো থেকে ১ একর জায়গা কিনলে ১শত একরের বেশী দখল করে।

এই বিষয়ে রবিউল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ম্রো’রা জায়গা বিক্রি করলে আমরা কিনবোনা ? আমরা টাকা দিয়ে কিনেছি। কি পরিমাণ জায়গার কাগজ আরে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেননি। লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ সরই এর পরিচালক কামাল উদ্দিন বলেন, আমরা এলাকার উন্নয়নে বাগান করতে চাই। কারো জায়গা দখল করতে যাব কেন ? পাড়ার চলাচলের রাস্তা দখল করার বিষয়টি জানিনা। মোস্তফা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা পোপা মৌজায় জায়গা ক্রয় করছিনা।

পোপা মৌজার হেডম্যান যোহন ম্রো বলেন, আমি রবিউল হোসেন ভূঁইয়া, কামাল উদ্দিন ও শফিক উদ্দিন আহমদ নামে কাউকে কোন হেডম্যান রিপোর্ট দেয়নি। তারা যে আমার মৌজায় জায়গা ক্রয় করেছে তা আমি জানিনা। জবরদখলের বিষয়ে এলাকার লোকজন আমাকে জানিয়েছে।

লামা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন বলেন, জেলা প্রশাসকের কাছে করা অভিযোগের কপি আমাকেও দিয়েছে ম্রো লোকজন। আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সাথে বসে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।

লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ জান্নাত রুমি বলেন, জেলা প্রশাসন হতে অভিযোগটি তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা দায়িত্ব দেয়া হলে বিষয়টি তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নিব। এখনো অফিস আদেশ আমার কাছে পৌঁছায়নি। তবে মুরুং জনগোষ্ঠীর করার অভিযোগের অনুলিপি আমি পেয়েছি।

পাঠকের মতামত: