ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

লামা ও আলীকদমের পাহাড়ি পল্লীতে বিশুদ্ধ পানির সংকট

লামা-আলীকদম প্রতিনিধি ::

বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার অধিকাংশ পাহাড়ি পল্লীগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর শুস্ক মৌসুম এলেই বিশুদ্ধ পানির এ সংকট তীব্র আকার ধারন করে এতদ্বঞ্চলে। পাহাড় ঝিরি খুঁড়ে অবাধে পাথর উত্তোলন ও বৃক্ষ নিধন ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া, বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক স্থাপিত অধিকাংশ রিংওয়েল, টিউবওয়েল অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকা এবং কিছু কিছু স্থানে জনসংখ্যার তুলনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিউবওয়েল না থাকায় পানির সংকট সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয় সচেতনমহল জানিয়েছেন। পানির অভাবে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ও বাঙালিরা পাহাড়ি ঝিরি, ঝর্ণা, পাতকূয়া, নদী ও পুকুরের পানি পানসহ দৈনন্দিন কাজে বাধ্য হয়েই ব্যবহার করছে। এতে করে জন্ডিস, ডায়রিয়াসহ নানান পানি বাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার অশংকা দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। পাহাড়ি জনপদে বিশুদ্ধ পানির সংকট লাঘবে জনসংখ্যার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিউবওয়েল রিংওয়েল স্থাপনসহ অকেজোগুলো জরুরী ভিত্তিতে সংস্কারের দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লামা ও আলীকদম উপজেলার ১১ টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভা এলাকাটির অধিকাংশই পাহাড়ি জনপদ। তাই শুস্ক মৌসুম শুরু হলেই নদী, ঝিরি ও পুকুরের পানি কমে যায়। আর দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির সংকট। এতে করে লামা উপজেলার গজালিয়া, লামা সদর, ফাঁসিয়াখালী, আজিজনগর, সরই, রূপসীপাড়া এবং ফাইতং ইউনিয়ন এবং আলীকদম উপজেলার আলীকদম সদর, চৈক্ষ্যং, নয়াপাড়া ও কুরুকপাতা ইউনিয়ন এবং লামা পৌরসভার বিভিন্ন পাড়া ও গ্রামের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষকে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। লামা পৌরসভা এলাকার বাসিন্দারা কিছুটা বিশুদ্ধ পানি পেলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিশুদ্ধ পানির অভাবে এলাকার লোকজনের মধ্যে গত ২০-২৫ দিন আগে থেকেই রীতিমত হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ তাদের নিজ নিজ ইউনিয়নগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সমস্যার কথা স্বীকার করে দ্রুত এ অবস্থার উত্তরণে সংশ্লিষ্ট বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

লামা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে নলকুপ, ডি.এস.পি নলকূপ, তারা ডিপসেট, গভীর নলকূপসহ বিভিন্ন ধরনের নলকূপ রয়েছে ২ হাজার ৪৮৭ টি। তার মধ্যে ৯শ’ ১৩ টি অকেজো অবস্থায় রয়েছে। অবশ্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্যানুযায়ী প্রায় ১ হাজার ২শ’নলকূপ অকেজো অবস্থায় রয়েছে। অপরদিকে আলীকদম উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নেও বেশির ভাগ নলকূপ অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আলীকদমের চৈক্ষ্যং এলাকার আব্দুল কাদের, আকবর আলী, মহসিন এবং লামা সরই ইউনিয়নের মো. সেলিম উদ্দিন. মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বলেন, এলাকার বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে বসবাস করার কারণে নিজেদের উদ্যোগে খুব কম সংখ্যক মানুষ টিউবওয়েল স্থাপন করতে পারেন। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে টিউবওয়েল স্থাপনের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। ঠিকাদারী দূর্নীতির কারণে স্থাপিত টিউবওয়েলগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে। তারা আরও জানান, সাধারণত ঠিকাদারেরা শুস্ক মৌসুমে টিউবওয়েল বসানোর কাজ না করে, বর্ষা মৌসুম কিংবা বর্ষার শেষের দিকে কাজ করে থাকে। যার করণে অল্প গভীরতায় পানির স্তর পাওয়া যায়। পরক্ষণে শুস্ক মৌসুম এলেই ওই সকল টিউবওয়েল ও রিংওয়েলগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কেউ ঝিরির পানিতে থালা-বাসন ও কাপড় ধুচ্ছেন, আবার কেউ খাবার পানি সংগ্রহ করছেন, কেউ একই পানিতে গোসলও সারছেন। এ সময় কাঁঠালছড়া ত্রিপুরা পাড়ার গৃহবধূ শলতি ত্রিপুরা জানান, পাড়ার টিউবওয়েল অকেজো, তাই বাধ্য হয়ে পাহাড়ি ছড়া থেকে পানীয় ও দৈনন্দিন ব্যবহারের পানি সংগ্রহ করে থাকি। ছড়ার পানি খুব পরিষ্কার। সব কাজে আমরা এ পানি ব্যবহার করি। তবে বৃষ্টি হলে এ পানি আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। বৃষ্টিতে পাহাড়ের ময়লা-আবর্জনায় ভরে যায় ঝিরি। এছাড়া শুস্ক মৌসুমে ঝিরির পানিও কমে যায়। এতে করে আরও দুর্ভোগে পড়তে হয়। একই কথা জানালেন- গৃহবধূ বাস্মাতি ত্রিপুরা, মালতি ত্রিপুরা ও ভিউতি ত্রিপুরাসহ অনেকে। তারা আরও জানান, ঝিরি থেকে এক কলসি পানি সংগ্রহ করতে অনেক সময় লাগে। এ সময় আরও জানা যায়, সামান্য যন্ত্রাংশের অভাবে অনেক টিউবওয়েল অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারিভাবে ভর্তুকির মূল্যে টিউবওয়েলের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হলে অনেক টিউবওয়েল সচল করা সম্ভব হতো। একই অবস্থা বিরাজ করছে অপর ইউনিয়নগুলো পল্লীগুলোতেও। এতে দু’উপজেলার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ চলতি মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির অভাবে বাধ্য হয়ে পাহাড়ি ঝিরি, ঝর্ণা, পাতকূয়া ও নদীর পানি পানসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে চলেছে। ফলে জন্ডিস, ডায়রিয়াসহ নানা পানি বাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। অনেকেই ইতিমধ্যে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে উপজেলা সদর হাসপাতালসহ আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে লামা পৌরসভা মেয়র মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌর নাগরিকদের বিশুদ্ধ পানির সংকট লাঘবে নিয়মিত ভর্তুকি প্রদান করে পৌরসভার পানি সরবরাহ প্রকল্পটি চলমান রাখা হয়েছে। এর ফলে লামা বাজারসহ পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে বিশুদ্ধ পানির সংকট লাঘব হয়েছে।

লামা জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল অধিদপ্তরের উপ-সরকারি প্রকৌশলী মো. মুজিবুর রহমান জানায়, অবাধে পাথর উত্তোলন ও বৃক্ষ নিধনের ফলেই ভূ–গর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এ কারনে শুস্ক মৌসুম এলেই পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। তিনি বলেন, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে লামায় ১শ’টি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে ৭৬ টির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ৪০টি রিংওয়েল স্থাপন করা হচ্ছে। তম্মধ্যে ২৮টি স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। তিনি জানান, লামা পৌরসভার টি.টি এন্ড ডিসি এলাকায় স্থাপিত পানি সরবরাহ প্রকল্পটি চালু হলে পৌরসভা এলাকার বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পুরোপুরি লাঘব হবে।

পাঠকের মতামত: