ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইয়াবা পাচারে ৭৫ গডফাদার অপ্রতিরোধ্য

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ::
মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল থেকে ইয়াবার চালান সরবরাহ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবা প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও নেশার ভয়ানক ছোবল ওই ছোট্ট বড়ির চালান বিকিকিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বরাবরই অধরা থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা।

জানা যায়, সীমান্ত এলাকাসহ দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন ইয়াবার চালান জব্দ হচ্ছে। উদ্ধার ইয়াবার সঙ্গে আটক হওয়া ব্যক্তিরা শুধু বহনকারী। নেপথ্যেই থেকে যাচ্ছে ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত গডফাদাররা। বরাবরই ওসব গডফাদার রক্ষা পাওয়ায় দেশে ইয়াবা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও রাজধানীতে বসে তারা ইয়াবার চালান দেশে আনার পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে। টেকনাফ ও উখিয়ার ২০টি সিন্ডিকেটের কেউ আছে সীমান্ত এলাকায়। আবার কেউ কেউ রয়েছে শহর এলাকায়। নিরাপদ দালানে বসেই গডফাদাররা মিয়ানমার-বাংলাদেশ ভিত্তিক ইয়াবার চালান সরবরাহ কাজ মনিটরিং করছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা স্রোত সামাল দেয়ার কাজে স্থানীয় প্রশাসন ব্যস্ত থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে ইয়াবা গডফাদাররা। প্রতিরাতে নৌকাভর্তি ইয়াবার চালান এনেছে দেশে। এ খবর জানতে পেরে টেকনাফে ইয়াবাবিরোধী অভিযান জোরদার করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। জব্দ করা হয় লাখ লাখ ইয়াবার চালান। স্থলপথে কড়াকড়ি অবস্থা দেখে বর্তমানে মিয়ানমারের আকিয়াব থেকে ট্রলারে করে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে আসা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ওসব চালান সরাসরি মাছ ধরার ট্রলারের মাধ্যমে মহেশখালী, কুতুবদিয়া চট্টগ্রাম, আনোয়ারা, বাঁশখালী, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল এলাকায় গিয়ে খালাস করা হচ্ছে বলে সূত্রে জানা গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে তৈরি করা ইয়াবা গডফাদারের তালিকা রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ইতোপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত তালিকা মতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু কিছু ইয়াবা বিক্রেতাকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু গডফাদাররা অধরা রয়ে গেছে। ইয়াবা বিক্রেতা চুনোপুঠিরা ধরা পড়লেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় অপারেশন কার্যক্রম না থাকাসহ অজ্ঞাত কারণে গডফাদারদের ওই তালিকা অনেকটাই ফাইলবন্দী হয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিজ্ঞজনরা জানান, ইয়াবার সঙ্গে কারা জড়িত, গডফাদার কারা, কোথায় তাদের অবস্থান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত গডফাদাররা বর্তমানে কোন পথে ইয়াবার চালান ঢুকাচ্ছে দেশে, এসব কমবেশি জানা রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের। তবে টেকনাফ ও উখিয়ার কিছু অসৎ কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে ইয়াবা গডফাদারদের গ্রেফতার করছেনা। ওই অসৎ কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান দেশে নিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। ইয়াবা গডফাদারদের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা সর্বনিম্ন এক থেকে তিন লাখ টাকা হারে মাসিক চাঁদা নিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওসব গডফাদাররা টেকনাফ-উখিয়ার বাসিন্দা হলেও ইয়াবার চালান ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। ইয়াবার টাকার জোরে গত ইউপি নির্বাচনে অনেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে। তারা ইয়াবার চালান গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে সর্বদা বের করে চলছে নিত্যনতুন কৌশল। মালবাহী গাড়ির বডির সঙ্গে এমন কিছু গোপন জায়গা তৈরি করেছে, যা সহজে খুঁজে পাওয়া মুশ্কিল বলে সূত্রে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদাররা হচ্ছে- টেকনাফ শীবনিয়াপাড়ার হাজী সাইফুল করিম, টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ, তার পুত্র মোঃ শাহজাহান, দিদার মিয়া, আলিয়াবাদ গ্রামের আব্দুল আমিন, মোঃ আব্দুস শুক্কুর, পৌর কাউন্সিলর মৌলবি মুজিবুর রহমান, মোঃ শফিক, মোঃ ফয়সাল, সাবরাং বাজারপাড়ার সাহেদুর রহমান নিপু, ডেইলপাড়ার দুই সহোদর মোঃ আমিন, নুরুল আমিন, মৌলবিপাড়ার মোঃ একরাম হোসেন, পশ্চিম লেদার মোঃ নুরুল হুদা, আব্দুর রহমান, অলিয়াবাদ গ্রামের মারুফ বিন খলিল, সাইফুল ইসলাম, সাবরাংয়ের দুই সহোদর আকতার কামাল, শাহেদ কামাল, টেকনাফ সদরের খানকারপাড়ার কামরুল হাসান রাসেল, নয়াপাড়ার শামসুল আলম মার্কিন, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলবি আজিজ উদ্দিন, শামলাপুরের হাবিব উল্লাহ হাবিব, জালিয়াপাড়ার মোজাম্মেল হক, জোবাইর হোসেন, পল্লানপাড়ার আব্দুল হাকিম, কুলালপাড়ার নুরুল বশর, নাজিরপাড়ার জিয়াউর রহমান, আব্দুর রহমান, আচারবনিয়ার আবুল কালাম, ছৈয়দ হোসেন মেম্বার, কচুবনিয়ার মৌলবি বশির, খানকারপাড়ার মৌলবি বোরহান, শাহ আলম, হাতিয়ারঘোনার আব্দুল্লাহ, জাফর আলম, পশ্চিম লেদার মোঃ নুরুল কবির, গোদারবিলের আব্দুর রহমান, জিয়াউর রহমান, নাইট্যাংপাড়ার মোঃ ইউনুছ, হাবিবপাড়ার ইউছুফ জালাল বাহাদুর, হ্নীলার নির্মল ধর, ফুলের ডেইলের মোঃ রাশেদ, মাহবুব মোরশেদ, বাজারপাড়ার মোহাম্মদ শাহ মালু, উলুমচামরীর আব্দুল হামিদ, রঙ্গীখালীর হেলাল আহমেদ, সদ্য সৌদি ও মালয়েশিয়া ফেরত দুই সহোদর শামসুল আলম, ফরিদ আলম, জাদিমুরার মোঃ হাসান আব্দুল্লাহ, পশ্চিম সিকদারপাড়ার ছৈয়দ আহমদ, হাজিরপাড়ার জহির উদ্দিন, উত্তর জালিয়াপাড়ার মোস্তাক আহমেদ, জয়নাল উদ্দিন, মোঃ আলী, আবুল কালাম, জুমছড়ির সুরত আলম, নুরুল আলম, হাবিব উল্লাহ, জসিম উদ্দিন, আব্দুর রহিম, উখিয়ার মাহমুদুল করিম, মাহমুদুল হক,আতাউল্লাহ,মির আহমদ, রহমত উল্লাহ ওরফে কালু, সুশীল বড়ুয়া মিস্ত্রি, উখিয়ার চাকবৈঠার রোস্তম আলী (প্রকাশ এসক্রাফ রোস্তম,করইবনিয়ার ইকবাল, গোয়ালিয়ার মোস্তাক আহমদ, বালুখালীর জাহাঙ্গীর আলম, এনামূল হক, জয়নাল, ছৈয়দ নুর, তার ভগ্নিপতি মোহামদুল হক, আলা উদ্দিন, থাইংখালীর কলিম উল্লাহ ওরফে লাদেন, নুরুল আমিন মেম্বার, জয়নাল মেম্বার, আবুল হাশেম, সোহেল ও আনোয়ার। এদের মধ্যে কেউ কেউ ইয়াবাসহ ইতোপূর্বে ধরা পড়লেও বেশি দিন জেল খাটতে হয়নি তাদের। জামিনে মুক্ত হয়ে এসে ফের পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াবার কারবার।

সীমান্তের একাধিক সূত্র মতে, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় শিবিরে অবস্থানকরা কিছু কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারে গিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে নির্বিঘেœ। নিজ দেশে থাকা অবস্থায় যারা ইয়াবা পাচার কাজে জড়িত ছিল, তাদের সঙ্গে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য রয়েছে। তাই ওই চিহ্নিত রোহিঙ্গাদের বেলায় ইয়াবার চালান আনার জন্য মিয়ানমারে যাওয়া-আসা করতে মোটেও বাঁধা নেই বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পুলিশের (বিজিপি) কাছে তাদের তালিকা রয়েছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত পণ্য এই মাদকের লাখ লাখ পিস চালান যারা ইতোপূর্বে বিজিপির সহযোগিতায় বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। তারাই (রোহিঙ্গা) বর্তমানেও বিজিপির সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াবার বড় বড় চালান সীমান্ত এলাকায় এনে তুলে দিচ্ছে চিহ্নিত গডফাদারদের হাতে। কিছু কিছু চালান টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জব্দ হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইয়াবার চালানসহ ধরাও পড়েছে বহু রোহিঙ্গা।

পাঠকের মতামত: