ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

কৃষি জমিতে তামাকের আগ্রাসন

নিজস্ব প্রতিনিধি ::

পাহাড়ের সমতল ভূমি ও নদী তীরবর্তী ফসলি জমিতে চলছে তামাকের আবাদ। এতে বিনষ্ট হচ্ছে খাদ্য শস্য উৎপাদন। অতীতে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য অঞ্চলে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ থাকলেও বর্তমানে সবজিসহ নানা রকম কৃষি পণ্য সমতলের বিভিন্ন জেলা থেকে আমদানি করতে হয়। বিগত এক দশক ধরে পাহাড়ে বেড়েছে তামাকের আবাদ। অতি মুনাফা এবং তামাক কোম্পানির নানা প্রলোভনে পড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছে কৃষক। এতে সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট, খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি, জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস এবং তামাক চাষীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশংকা তৈরি হয়। অতীতে পাহাড়ে তামাক আবাদ কম থাকলেও বর্তমানে চাষের জমির পরিমান অনেক বেড়েছে। যেখানে ৬০ শতাংশ কৃষক জুম করত, সেই জুমিয়া বা সাধারণ কৃষকদের প্রায় ৯০ শতাংশই বর্তমানে তামাকের আবাদ করছে। যার অধিকাংশই ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর চুক্তিবদ্ধ কৃষক। কোম্পানি নানাবিধ সুবিধার মাধ্যমে কৃষকরা তামাক চাষে আকৃষ্ট হচ্ছে। জেলার প্রায় ছয়’শ হেক্টর জমিতে তামাকের আবাদ হচ্ছে।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মাইনী নদীর তীরবর্তী কৃষি জমি, সমতল ভূমি, মাটিরাঙা, পানছড়ি, মহালছড়ি, মানিকছড়ি পর্যন্ত সর্বত্র তামাকের আগ্রাসন। তামাক উৎপাদন দেশের বিভিন্ন জেলায় উৎপাদন হলেও খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলায় এর চাষাবাদ আশাংকাজনকভাবে বেড়েছে। জেলার অন্যতম শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত দীঘিনালায় সবচেয়ে বেশি তামাকের চাষ হয়।

এছাড়া নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহে সবচেয়ে বেশি তামাকের আগ্রাসনের শিকার। এছাড়া তামাকের চুল্লিতে পাতা শোধনের জন্য ব্যবহার করছে বনের কাঠ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাগড়াছড়িতে তামাক চাষের নেপথ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিক্যান টোবাকো। প্রায় ৭০ শতাংশ তামাকের এর ক্রেতা এই কোম্পানি। এছাড়া অন্যান্য কোম্পানি তামাকের আবাদ শুরু করেছে।

জেলার দীঘিনালার মাইনী নদী সংলগ্ন কবাখালি, মেরুং অঞ্চলে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ‘কিলোমিটার পর কিলোমিটার জুড়ে কৃষি জমিতে দেদারছে চলছে তামাকের আবাদ। এসব জমিতে এক সময় শীতকালীন সবজিসহ নানা রকম ফসল উৎপাদন হলেও সেসব জমি বর্তমানে তামাকের দখলে। বাংলাদেশ ব্যাংক তামাক চাষীদের অনুৎসাহিত করতে ঋণ প্রদান না করলেও তামাকের কোম্পানিগুলো কৃষকদের ঋণ, সার, বীজ, কীটনাশক সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়া তামাকের আবাদ লাভজনক এবং উৎপাদিত তামাক কোম্পনিগুলো কিনে নেওয়া বিপণন প্রক্রিয়া ঝামেলাহীন। আগস্ট–সেপ্টেম্বরে তামাকের চারা উৎপাদন শুরু হয়। অক্টোবর–নভেম্বর চারা রোপণ করা শুরু হয় এবং জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে তামাকের পাতা তোলা শুরু হয়। তামাকের পাতা চুল্লিতে দিয়ে শোধন বা কিউরিং করা হয়। সনাতন পদ্ধতিতে তামাকের চুল্লি বানিয়ে তাতে বনের কাঠ পুড়িয়ে পাতা শোধন করা হয়। এতে বিপুল বনের কাঠ নষ্ট হয়। একটি চুল্লিতে মৌসুমে শত মণ নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো হয়।

তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ায় দুর্গম পাহাড়ে জুমিয়া ও সাধারণ কৃষকদের জীবন ধারা ও শস্য উৎপাদনে পরিবর্তন এসেছে। এক সময় জুমে ৩২ রকমের সবজি উৎপাদন হত কিন্তু বর্তমানে জুমে নিজের প্রয়োজনীয় শস্য উৎপাদন করে। তামাক অর্থকরী ফসল হওয়ায় জুমিয়া ঐতিহ্যবাহী জুম চাষে অনভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। অতীতে পাহাড়িদের বাজার থেকে তেমন সবজিসহ কৃষিজ পণ্য কিনতে হত না। কিন্তু বর্তমানে খাদ্য শস্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় তামাক বিক্রির টাকা দিয়ে খাদ্য শস্য কিনতে হয়। জুমের চাষ কমে যাওয়ায়, জুম ফসলের মাতৃবীজও বিলুপ্ত হচ্ছে।

অনেক কৃষক বলেন,জমিতে তামাক চাষের কারণে জমির উর্বরতা কমে যায়, মাটিতে কেঁচোসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রাণীর সংখ্যা কমে আসে, জমির মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং তামাকের জমিতে পরবর্তীতে ফসলের উৎপাদন কমে যায়।

তামাক চাষে আর্থিকভাবে সাময়িক লাভবান হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকে দীর্ঘমেয়াদি। এক বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, ‘একজন তামাক চাষির গড় আয়ু মাত্র ৫৫ বছর, যা অন্য চাষির তুলনায় প্রায় ১১ (এগার) বছর কম। এছাড়া তামাক চাষ ও তামাকের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়।

তামাক চাষে কৃষি, বন ও জনস্বাস্থ্যে ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও সরকারকে বিপুল কর দেওয়ায় তা বন্ধ বা নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। তবে তামাকের কারণে কৃষিতে যে প্রভাব পড়ছে তাতে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপ পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, তাৎক্ষণিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষে আকৃষ্ট হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে বেশির ভাগ তামাক চাষ হয় বেসরকারি ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো অধীনে। তারা কৃষকদের ঋণ দিয়ে চাষাবাদে আগ্রহী করে তোলে। নগদ অর্থ প্রাপ্তির জন্যই কৃষকরা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য ফসলের ঝুঁকি থাকলেও তামাক চাষে ঝুঁকি কম। তামাক কোম্পানিগুলোই উৎপাদিত তামাক কিনে নেয়। জেলার প্রায় ৭০০ একর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে।

পাঠকের মতামত: