ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিয়ের ফাঁদে পড়ে চীনে পাচার হচ্ছে তরুণীরা

টার্গেটে অল্প শিক্ষিত পাহাড়ি মেয়ে, ১০ ম্যারেজ মিডিয়া শনাক্ত * উন্নত জীবনের আশায় ফাঁদে পা দিচ্ছে পাহাড়িরা * লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে চীনা নাগরিক বিয়ে নিষিদ্ধ

অনলাইন ডেস্ক ::

চীনা নাগরিকদের বিয়ের ফাঁদে পড়ে পাচার হচ্ছে পাহাড়ি মেয়েরা। এ কাজে বাংলাদেশ ও চীনে একাধিক শক্তিশালী চক্র সক্রিয়। গত প্রায় ছয় মাস ধরে অভিনব কায়দায় এই নতুন রুটে নারী পাচার হচ্ছে। ম্যারেজ মিডিয়ার আড়ালে চক্রের সদস্যরা এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক মেয়েকে চীনে পাচার করেছে। অল্প শিক্ষিত সহজ-সরল দরিদ্র পাহাড়ি মেয়েরাই হচ্ছেন এর প্রধান টার্গেট।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছে, প্রাথমিক যোগাযোগের পর চীনা নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে বিয়ের পর চীনে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরই তাদেরকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অন্ধকার জগতে বিক্রি করে দিচ্ছে। উন্নত জীবনের আশায় মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে পার্বত্য জেলার মেয়েরা পাচারের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির সুর্বণা চাকমা (২৩) নামের এক মেয়েকে পাচারকালে চীন নাগরিকসহ তিনজনকে ডিবি পুলিশের গ্রেফতারের পর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়ে আসে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলেন, অভিনব কায়দায় চীনে নারী পাচার করছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। দেশের কয়েকটি ম্যারেজ মিডিয়া এ জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত। অপরাধ বন্ধে দু’দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কাজের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়িদের সরলতা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে পুঁজি করে এভাবে নারী পাচার করছে সংঘবদ্ধ চক্র। পাচার বন্ধে তারা সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে ও দু’দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।নারী পাচারের সঙ্গে রাজধানী উত্তরার এম এন্টারপ্রাইজ, লাইফ মিডিয়াসহ অন্তত ১০টি ম্যারেজ মিডিয়ার সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকার এই ম্যারেজ মিডিয়াগুলো মূলত পাহাড়ি মেয়েদের তথ্য সংগ্রহ করে চীনা মিডিয়াগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। চীনা ম্যারেজ মিডিয়া থেকে তথ্য নিয়ে চীনা পুরুষরা ঢাকায় ছুটে এসে বাংলাদেশের ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বিয়ে করছে। চেহারা ও ধর্মের মিল থাকায় বিয়েতে তেমন জটিলতা হয় না। কোর্টের মাধ্যমে বিয়ে করে চীনা দূতাবাসে নিয়ে যাওয়া হয় এসব মেয়েকে। পরে দূতাবাসের অনুমতি নিয়েই নববধূ হিসেবে পাহাড়ি মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়। পাচারের অভিযোগে গত বছরের ৮ নভেম্বর উত্তরা থেকে ২য় ম্যারেজ মিডিয়ার মালিক হাতেমকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে হাতেম ডিবিকে চীনে নারী পাচারের নতুন রুট ও সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্র সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, এ ধরনের প্রতি বিয়েতে তারা ৩০ হাজার টাকা করে পান। তবে চীন থেকে বাংলাদেশে আসা, থাকা-খাওয়া, বিয়ে করা, বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া, ম্যারেজ মিডিয়ার কমিশন মিলে মোট ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে ৬০ নারী ও শিশু। তাদের মধ্যে ৩৫ জন নারীকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ২০১৭ সালে বিভিন্ন দেশে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া ৯ নারীকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কথা হয় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সমন্বয়ক আবু আহম্মেদ ফয়জুল কবিরের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের হাতে অনেক নারী পাচার হচ্ছে। আবার অনেকে বৈধ পথে গিয়েও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বেশ কয়েকজন নারীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলছেন, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে। চীনের অনেক নাগরিক এ দেশে বিনিয়োগ করছে। এ ধরনের অপরাধের ফলে দুই দেশের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই শুরুতেই এ ধরনের অপরাধ বন্ধে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও এজাহার সূত্রে জানা যায়, পাচারের শিকার হচ্ছে বুঝতে পেরে সুবর্ণ চাকমা নামের এক পাহাড়ি মেয়ের পরিবার ডিবি পুলিশকে খবর দেয়। পরে অভিযান চালিয়ে উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর রোডের ৬৮ নম্বর বাড়ির ৬ তলা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় জড়িত চীনা নাগরিকসহ ম্যারেজ মিডিয়ার দু’জনসহ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এরা হচ্ছেন আছাফুন নাহার লিপি, ঢাকার উত্তরায় বসবাসরত চীনা নাগরিক জু-হান ও ম্যারেজ মিডিয়ার জামান ও রশিদ। জিজ্ঞাসাবাদে জামান ও রশিদ তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানায়, তারা এভাবে মারশী চাকমা, ইলা চাকমা, হেলেনা চাকমাসহ বেশ কয়েকজন নারীকে চীনে পাঠিয়েছে।

তদন্তের অংশ হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে চীনে যাওয়া ২ পাহাড়ি তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিবি পুলিশ। তরুণীদের সঙ্গে তারা ইমোতে ভিডিও কল করে। তদন্তের কৌশল হিসেবে ডিবির কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে সকালে, দুপুরে, রাতে এবং এমনকি মধ্যরাতে কথা বলেন। ওই কর্মকর্তা জানান, তারা ফোনে বলেছে ভালো আছে। তবে আমাদের কাছে একটা জিনিস অবাক লেগেছে। যখনই তাকে ভিডিও কল দেই তখনই তার পেছনে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখা যায়। তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার তরিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গত এক বছর ধরে এ ধরনের পাচার হচ্ছে। পুরো বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।

ভুক্তভোগী সুবর্ণা চাকমা যুগান্তরকে বলেন, দরিদ্রতার কারণে চাকরি খুঁজছিলাম। এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে আছাফুন নাহার লিপির সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে চীনে ভালো চাকরি দেয়ার কথা বলে উত্তরার একটি ম্যারেজ মিডিয়াতে নিয়ে আসে। পরে বুঝতে পেরে বিষয়টি পরিবারকে জানালে ডিবি আমাকে উদ্ধার করে।

টার্গেট পাহাড়ি নারী : মূলত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের মেয়েরাই তাদের টার্গেট। তাদেরকে সহজেই বুঝিয়ে চীনাদের সঙ্গে বিয়েতে রাজি করানো হয়। এমনকি তারা কৌশলে পাচারের শিকার মেয়েদের দিয়ে প্রতিবেশী নারী ও স্বজনদের ফোন করিয়ে তাদের প্রলুব্ধ করেন। নানাভাবে তাদেরকে লোভ দেখানো হয়। এভাবেই তাদেরকে ফাঁদে ফেলা হয়।

যে কারণে নতুন রুট বাংলাদেশ : এর আগে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা বিয়ের জন্য লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে যেত। পরে সে দেশের সরকার বিদেশিদের বিয়ে করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে তারা বাংলাদেশমুখী হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরমান আলী যুগান্তরকে বলেন, ঘটনা তদন্তে চীনে যাওয়া জরুরি। এরই মধ্যে চীনে যাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: