ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের সীমানা দেওয়াল হবে কবে? রক্ষা পাচ্ছেনা শতবর্ষী ‘মাদার ট্রি’

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন নগর কক্সবাজার যাওয়ার সময় চোখে পড়ে চকরিয়ার খুটাখালী মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান। ৩৯৬ হেক্টর বনভূমির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে গর্জন বৃ সমৃদ্ধ দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ এই জাতীয় উদ্যান। মাদার ট্রি সমৃদ্ধ এই বনভূমিকে ২০০৪ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কথা ছিল এই জাতীয় উদ্যানের ১০ হাজার ৩৩৭টি মাদার ট্রি রক্ষায় উদ্যানের চারপাশে সীমানা দেওয়াল নির্মাণ করার। এজন্য আর্ন্তজাতিক সংস্থা অরণ্য ফাউন্ডেশনের কাছে ১৫ কোটি টাকা সহযোগিতা চেয়ে একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছিল বনবিভাগের পক্ষ থেকে। কিন্তু জাতীয় উদ্যান ঘোষণার ইতিমধ্যে ১৪ বছর পার হতে চললেও ওই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্ত গগণচুম্বি সমৃদ্ধ দেশের প্রথম এই গর্জন বাগানের মাদার ট্রি লোপাট হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

তবে বনবিভাগ বলছে, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষী মাদার ট্রি রক্ষায়। এমনকি ক্রেল প্রকল্পের মাধ্যমেও সিএমসি কমিটি গঠন করে জাতীয় উদ্যানের মাদার ট্রি রক্ষায় কাজ করা হচ্ছে। এর পরেও উদ্যানের মাদার ট্রি লোপাট হয়ে থাকলে তা খুবই দুঃখজনক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চকরিয়ার খুটাখালীতে গর্জন বৃক্ষসমৃদ্ধ বনভূমিকে দেশের প্রথম ও একমাত্র সর্ববৃহৎ ‘ন্যাশনাল পার্ক’ বা ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতার কারণে পরিপূর্ণ জাতীয় উদ্যানে রূপ নিতে পারছে না। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের আওতাধীন চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের দুইপাশের ৩৯৬ হেক্টর বনভূমি নিয়ে এই ন্যাশনাল পার্কের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৪ সালে। ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণার ১৪টি বছর অতিবাহিত হলেও এই পার্কের উন্নয়ন খাতে সরকারী কাঙিক্ষত বরাদ্দ না থাকায় এই পার্কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। বনদস্যুদের বেপরোয়া তৎপরতায় একের পর এক মাদার ট্রি (শতবর্ষী গর্জন) নিধন হচ্ছে। ন্যাশনাল পার্ক বাস্তবায়নের ঘোষণার পর এই পর্যন্ত কয়েক কোটি টাকামূল্যের মাদার ট্রি নিধন হয়েছে। ২০০৪ সালের গণনায় পার্কে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা মূল্যের ১০ হাজার ৩৩৭টি মাদারট্রি রক্ষিত ছিল। এসব মাদার ট্রি বনদস্যুদের কবল থেকে রক্ষার জন্য গর্জন বাগান এলাকার চারপাশে সীমানা দেওয়াল নির্মাণ করা প্রয়োজন হলেও তা করা সম্ভব হয়নি।

বনবিভাগ সূত্র জানায়, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ফুলছড়ি রেঞ্জের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মেদাকচ্ছপিয়া বনবিটের আওতাধীন (কক্সবাজার–চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন) ১০ হাজার ৩৩৭টি শতবর্ষী গর্জন গাছসমৃদ্ধ ৩৯৬ হেক্টর বা প্রায় ৯৭৮ একর জমিতে ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। গত ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওই বনভূমিকে ‘ন্যাশনাল পার্ক’ বা জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। ঘোষণাকালে এই পার্কের আওতায় সাড়ে ১০ হাজারেরও বেশি মাদারট্রি থাকলেও বনদস্যুদের অব্যাহত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে সদ্য সমাপ্ত জরিপে ৯ হাজার শতবর্ষী গর্জন গাছ রয়েছে বলে ওই রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন।

সরজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাঠ চোরাকারবারী ও বনদস্যু সিন্ডিকেট সদস্যরা কয়েক ধাপে বিভিন্ন কৌশলে পার্কের বৃক্ষ নিধন করে থাকে। তারা এ কাজে ব্যবহার করে নারী–শিশুদেরকেও। প্রতিদিন ভোর ও সন্ধ্যায় নারী ও শিশুদের মাধ্যমে তারা প্রথমে গর্জনবৃক্ষের গোড়া ছেঁটে (গার্ডলিং) ফেলে। কেউ কেউ গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করে তুঁতেও। গার্ডলিং ও তুঁতে প্রয়োগের কারণে গাছের ডালপালা পাতা শুকিয়ে যেতে শুরশু করলে কাঠ চোরেরা গাছে ওঠে প্রথমে ডালপালা কেটে ফেলে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত হলে করাত দিয়ে কেটে নেওয়া হয় গোড়া থেকেই।

এদিকে বনবিভাগ সূত্র জানায়, ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণার ১৪ বছর অতিবাহিত হলেও প্রস্তাবিত ন্যাশনাল পার্ক বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার পর্যটন শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের দুইপাশে বিস্তৃত শতবর্ষী প্রাকৃতিক গর্জন বাগান মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান বা ন্যাশনাল পার্ক।

১৯৯১ সালের পর এখানকার বৃক্ষরাজিতে ভরপুর পাহাড় দখল করে অবৈধ বসতি স্থাপন করে উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলের ঘূর্ণিবিধ্বস্ত লোকজন। গহীন এই বাগানে বসতি গড়ে উঠার পাশাপাশি বনদস্যুরা দিবারাত্রি এই বিশাল গর্জন বাগানের অসংখ্য শতবর্ষী মাদারট্রি উজাড় ও পাচারে লিপ্ত রয়েছে। এজন্য পরিবেশবাদীসহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে নান্দনিক গর্জন বাগানটি রক্ষার জন্য হলেও এটিকে গড়ে তোলা হোক ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে। কেননা দেশের অন্য কোথাও এই বাগানের মতো বড় আকারের গর্জন গাছ নেই। গর্জন গাছের বীজও সংগ্রহ করা হয় এই বাগান থেকেই।

মেদাকচ্ছপিয়া বনবিট কর্মকর্তা সৈয়দ আবু জাকারিয়া বলেন, ‘গত তিনবছরে এই জাতীয় উদ্যান থেকে একটি গাছও কাটা পড়েনি। দিনরাত সমানে বনকর্মীরা এই পার্কের মাদার ট্রি রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত বনদস্যুদের হুমকির মুখে আছি আমরা। দিনের বেলায় যেমন–তেমন, রাতের বেলায় প্রাণ হাতে নিয়ে গাছ পাহারা দিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের মাদার ট্রি রক্ষায় চারপাশের ২৫ কিলোমিটার বনভূমিতে সীমানা দেওয়াল নির্মাণ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে এই জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষী মাদার ট্রিগুলো।

তিনি বলেন, ‘পার্কের আয় বর্ধনের জন্য ক্রেল নামক এনজিও সংস্থার সহায়তায় ১০টি তাবু স্থাপন করা হয়েছে পার্কে। যে কেউ ইচ্ছে করলে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে সেখানে রাতযাপনের সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে পার্ক এলাকায় শতাধিক গর্জন গাছ মারা পড়েছে। কিন্তু ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় এসব গাছ রোদে শুকে ও বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ।

পাঠকের মতামত: