ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

আ.লীগে গ্রুপিং, কৌশলী বিএনপি-জামায়াত(কক্সবাজার-১, চকরিয়া-পেকুয়া আসন)

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ::

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারের প্রবেশদ্বার কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নানামুখী তৎপরতা চলছে ভোটের মাঠে। এক্ষেত্রে বিএনপিকে বেশ কৌশলী মনে হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রকাশ্যেই নিজ নিজ বলয়ের নেতাকর্মীদের মাঠে-ময়দানে চষে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে দলটির গ্রুপিংও তুঙ্গে। সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে নানা আয়োজনে ব্যস্ত জাতীয় পার্টি (জাপা-এরশাদ) ও জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) নেতাকর্মীরাও। কক্সবাজারের রাজনীতির মোড়ল এলাকা হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর চকরিয়া। ২০০২ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার চকরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে নতুন উপজেলা পেকুয়া গঠন করে। বর্তমানে এ দুই উপজেলায় ৮ লাখ মানুষের বসবাস। আর মোট ভোটার ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৬ জন। এর মধ্যে চকরিয়ায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৫৩ জন ও পেকুয়ায় ১ লাখ ৪ হাজার ২২৩ জন। এ আসনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নির্ভর করে চকরিয়ার ভোটের ওপর।

স্বাধীনতার পূর্বে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী ও সাতকানিয়ার কোনো না কোনো থানার সঙ্গে চকরিয়াকে একীভূত করে সংসদ নির্বাচন হলেও স্বাধীনতার পর থেকে বৃহত্তর চকরিয়ায়কে কক্সবাজার-১ আসন নির্ধারণ করা হয়। ২০০২ সালে থেকে চকরিয়া-পেকুয়া নিয়ে গঠিত এ আসন। স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে একই প্রতীক নিয়ে ডাক্তার শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর দীর্ঘ ৪৪ বছরে অনুষ্ঠিত ৯টি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এখানে জয়ী হতে পারেননি। জামায়াত একবার, জাপা (এরশাদ) তিনবার ও বিএনপি পাঁচবার বিজয়ী হয়। বিশেষ করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পেকুয়ার সালাহউদ্দিন আহমদ তার সহকারী একান্ত সচিব এবং পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হলে চকরিয়া-পেকুয়া বিএনপির ঘাঁটিতে রূপ পায়। এ কারণে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আইনগত জটিলতায় সালাহউদ্দিন আহমদ নির্বাচন করতে না পারায় ধানের শীষের প্রার্থী হন তার সহধর্মিণী হাসিনা আহমেদ। নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন। বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমানে ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আইনগত জটিলতার কারণে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারলে তার স্ত্রী ফের দলীয় প্রার্থী হতে পারেন।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, সালাহউদ্দিন আহমদ যাকেই চাইবেন, তিনিই এ আসনে নির্বাচন করবেন। কর্মীরাও তার নির্দেশনায় চলবে। বর্তমান সরকার আমাদের সভা-সমাবেশ করতে না দিলেও সাধারণ ভোটাররা আমাদের পক্ষে রয়েছে। এসব ভোটাররাই বিএনপির শক্তি। আমাদের কৌশলে এগুতে হচ্ছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এ আসনে জামায়াতের অধ্যাপক এনামুল হক মঞ্জু দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। এরপর দলটি চারদলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে মনোনয়ন না পাওয়ায় আর কোনো নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী দেয়নি জামায়াত। একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতের নেতাকর্মীরা থেমে নেই। তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কর্মী সংগ্রহসহ দলীয় কর্মকা- চালাচ্ছে চুপিসারে। বিশেষ করে নারীদের জামায়াতের দিকে টানতে অত্যাধিক সক্রিয় দলটি। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে না পারলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন দলটির যেকোনো নেতা। তবে, এর আগে ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতের মনোনীত ব্যক্তিকে প্রার্থী করার চেষ্টা করা হবে বলে জানান জামায়াতের চকরিয়া দক্ষিণের সেক্রেটারি মোজাম্মেল হক। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা আলহাজ মোহাম্মদ ইলিয়াছ গত সংসদ নির্বাচনে মহজোটের প্রার্থী হয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। তিনি নির্বাচিত হয়ে চকরিয়া-পেকুয়ায় নীরব জাপাকে সরব করতে বিভিন্ন ইউনিয়নে কমিটি গঠন ছাড়াও কর্মী বাড়ানোর কাজ করছেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ফের আওয়ামী লীগ মহাজোটভিত্তিক প্রার্থী দেবে। সেক্ষেত্রে মো. ইলিয়াছ ফের মনোনয়ন পেতে পারেন বলে জাতীয় পার্টির নেতাদের অভিমত। তিনি আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ঘোষণা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দল জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রেসিডিয়াম সদস্য সালাহউদ্দিন মাহামুদ নিজেও মহাজোট থেকে প্রার্থী হতে যোগাযোগ রাখছেন বলে একাধিক সূত্র জানায়। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান, দুবার সংসদ সদস্য ছাড়াও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৫ সালের পূর্বে চকরিয়া আওয়ামী লীগের ঘাঁটি থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতা আর বজায় থাকেনি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ সালে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বিজয়ী হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়তে একাধিক নেতা মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমদ সিআইপি, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ জাফর আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক ড. মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম সজিব এবং জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ মিথুন। একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী হওয়ায় এ আসনে আওয়ামী লীগের গ্রুপিং এখন তুঙ্গে। চকরিয়া উপজেলা সভাপতি জাফর আলমকে ঘিরে মাঠে-ময়দানে প্রতিদিন চষে বেড়াচ্ছেন দুই উপজেলার ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। দলের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা একসঙ্গেই সভা-সমাবেশ করছেন। তাদের মধ্যে সালাহউদ্দিন আহমদ সিআইপি নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনবার নির্বাচনে অংশ নিলেও বিজয়ী হতে পারেননি। ড. মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম সজিব তরুণ নেতা হিসেবে দলীয় কর্মীদের কাছে আলাদা পরিচিতি লাভ করার পাশাপাশি পারিবরিক ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে মাঠে কাজ করছেন। তবে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতার অভিন্ন অভিমত যাকেই নৌকা প্রতীক দেওয়া হোক না কেন, দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সরব-নীরব গ্রুপিং পরিহার করে একাট্টা হয়ে নির্বাচন করলে আসনটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান বলেন, এখন অনেকে মাঠে কাজ করছেন। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই সবাইকে কাজ করতে হবে। দীর্ঘদিন নীরব থাকা বিএনপি হঠাৎ সরব হয়ে উঠেছিল খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফরকে ঘিরে। রোহিঙ্গাদের দেখতে যাওয়ার পথে চকরিয়ায় মহাসড়কজুড়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো হয়ে নেত্রীকে স্বাগত জানাতে গিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন প্রদর্শনের মাধ্যমে মূলত নির্বাচনী শোডাউনই করেন। পরে আওয়ামী লীগও পাল্টা শোডাউন করে। দলীয় সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতে হারবাংয়ের ইনানী ও চকরিয়া পৌরশহরের বাসটার্মিনালে পৃথক সমাবেশ করে। দুই শরিক জাপা ও জেপি মহাজোট থেকে এ আসনটি বাগিয়ে নিতে কেন্দ্রে তদবির চালিয়ে যাচ্ছে।

পাঠকের মতামত: