ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

বলিদান : বাল্যবিয়ে ও যৌতুকপ্রথা

ballo-bi-naশহিদ রাসেল :

 পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ সবদিক থেকেই অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকার তথা প্রশাসনের পাশাপাশি জনগণকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে অভিভাবকদের সচেতনতাকে নিশ্চিত করতে হবে। তথাকথিত ধারায় চলতে গিয়ে প্রতিদিন হাজারো অঘটনের জন্ম হচ্ছে। অল্পবয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা হচ্ছে। পারিবারিক চাপের কাছে পরাজিত হচ্ছে উদীয়মান স্বপ্নগুলো। তারুণ্যের দীপ্তি ছড়ানোর আগেই অবুঝ বালিকার জীবনে নেমে আসছে ঘোর অন্ধকার। যে বয়সে তার প্রজাপতি ধরার বয়স, মেঘের রং চেনার বয়স, একাডেমিক পড়াশুনা শেষ করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বয়স, চাকরি-সংসারের খুটিনাটি জানার বয়সেই তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বিয়ের আসর। আর কিশোর বয়সেই আটকে থাকছে পুরোটা জীবন। বাল্যবিয়ের এই ভয়াবহতা ও অভিশাপসরূপ গলার কাটাকে চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এই কু-প্রথাকে শক্ত পদক্ষেপে প্রতিহত করতে জনমত গঠন করতে হবে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার বিষয়টি জোরালোভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

অন্যদিকে যৌতুক প্রথার কুফল তো সবারই জানা। আর আমরা সজ্ঞানে এই ধ্বংসাত্মক ও ঘৃণ্য কাজটিকে বহন করে চলছি যুগের পর যুগ। এখন যৌতুক দেয়ার বিষয়টি অনেকটা ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। বলতে গেলে প্রতিযোগিতার মতো করে বাড়ছে যৌতুকের লেনদেন। এটি এক ধরনের মানুষ ক্রয়-বিক্রয়ের মতোই। অনেকটা অঘোষিতভাবেই বিয়ের বাজারে যৌতুকের বলিদান মহাসমারোহে চলছে। এ বিষয়ে কেউ অসম্মতি বা প্রতিবাদ করলে তাকে বলা হচ্ছে আন্কালর্চাড (অসভ্য)। আর যৌতুকের অপসংস্কৃতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সমাজের অসহায় পরিবারগুলো। বিত্তবানদের কাছে যৌতুকের বিশাল বাজেটই হলো সামাজিক স্ট্যাটাস। এই মানদ-ে (!) উত্তীর্ণ হতে না পারলে তার সাথে মেলামেশাও বন্ধ করে দেয়া হয়। মূলত যৌতুকের মতো অপরাধগুলোর প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক হলেন বেহিসেবি বিত্তবানশ্রেণী। তাদের লোকদেখানো অনেক অনুষ্ঠানের মধ্যে যৌতুক অন্যতম। তবে এব্যাপারে কনেপক্ষ বা বরপক্ষ কাউকে এককভাবে দোষারোপ করা যায়না। এটি মূলত: পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যা, যা দীর্ঘদিন ধরে অন্ধবিশ্বাসের মতো পালিত হয়ে আসছে।

বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথার মধ্যে নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। এই দু’টি জঘণ্য অপরাধের প্রচলিত আইনে বিচার থাকলেও তা বাস্তবায়নের তেমন একটা দৃষ্টান্ত নেই, থাকলে তা অপ্রতুল। এক্ষেত্রে অভিভাবক সমাজ ত্রাতার ভূমিকা পালন করেন। এসব অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে সামাজিক প্রথায় পরিণত করার পিছনে অভিভাবক বা সমাজপতিরাই দায়ি। সমসাময়িক বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো দেখলে মনে হয়, খরচ করার জন্য কোমর বেঁধে নামার মতো। যে দেশে এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ দু’বেলা খেতে পায়না, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত, চিকিৎসার অভাবে অকাল মৃত্যু’সহ মৌলিক অধিকার রক্ষা হয়না, সে দেশে ¯্রফে বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচাপাতি দেখে সংশ্লিষ্টদেরকে অবিবেচকই মনে হয়। আরেকটি বিষয় হলো – অপচয়। বিয়ে বাড়িতে খাবার-দাবারের দেদারসে অপচয় হয়। পার্টি-ফ্যাশন শো’সহ পশ্চিমা কালচারগুলোতে মাতিয়ে রাখা হয়। একটা ইচ্ছে-তাই ভাব নিয়ে সবধরনের আয়োজন, সাজ-সাজ আলোকবাতি। আবার তা-ও এসব তথাকথিত মানবশ্রেণি অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে থাকেন। এগুলোকে নাম দেয়া হয়েছে ‘জাতে উঠা’।

বাল্যবিয়ের কারণে সেসব প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয় তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পুরো জীবনটাকেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এছাড়া স্বাস্থ্যের প্রতি চরম হুমকি’সহ নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। মানসিকভাবে পুরো সংসারের চাপ নেয়ার বিষয়টি ব্যক্তিকে অসহায় করে তোলে এবং সংসারে অশান্তি ও দ্বন্দ্ব সহাবস্থান করে। আবার যৌতুক দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকে ঋণ বা সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে দায়গ্রস্ত জীবন বরণ করে নেন। ফলে বিয়ের পর থেকে সংশ্লিষ্ট পরিবারের উপর ধারাবাহিকভাবে চাপ আসতে থাকে। যৌতুক লোভীদের অসীম চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অনেক পরিবারকে পথে বসতে হয়।

তাই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে মানুষের মন থেকে কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করতে হবে। আলোকিত মানুষ তৈরীতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সমাজ/পরিবার হতেও প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে মানুষের মধ্যে দাসত্বভাব তৈরি হয়, যা তার পরবর্তী জীবনকালে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। আর প্রতিবাদ করার মানসিকতা চর্চা করতে হবে। অধিকার সচেতন না হলে একে অপরের সাথে সভ্য আচরণ বিনিময় হয়না। দায়িত্বজ্ঞানকে শাণিত করতে হলে আমাদেরকে প্রকৃতি ও জীবনবোধকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সমাজের সময়োপযোগী পরিবর্তনগুলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ ও বিচক্ষণতার সাথে গ্রহণ/বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।।

ংযধযরফৎঁংংবষ১৯৭১@মসধরষ.পড়স

পাঠকের মতামত: