ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘সরাসরি ত্রাণ দেয়া যাবে না’ রাস্তায় রাস্তায় ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা

rohigaকক্সবাজার প্রতিনিধি ::

উখিয়াটেকনাফে রাস্তায় রাস্তায় রোহিঙ্গার ঢল। ত্রাণ পাবার আশায় রাস্তার ধারে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা যাচ্ছে না সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া জায়গায় গড়ে ওঠা ক্যাম্পে। এতে এক শ্রেণির দালালও তাদের ইন্ধন যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ত্রাণ বিতরণ সহ রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ সহ মানবিক সহযোগিতা দেয়ার ক্ষেত্রে রাস্তায় রাস্তায় দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। ত্রাণ নিতে এসে হুড়োহুড়িতে গতকাল গাড়ি চাপায় উখিয়ার ঘাট কাস্টমস এলাকায় ৭ বছরের একটি রোহিঙ্গা শিশু ও আগের দিন বুধবার বিকেলে বালুখালীতে একজন রোহিঙ্গা পুরুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হচ্ছে বেশিরভাগ শিশু। ত্রাণ বিতরণে সরকার ইতোমধ্যে নিয়ম পালনের নির্দেশনা দিলেও মানছে না কেউ। এরই প্রেক্ষিতে শৃঙ্খলা আনতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমূহে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষে কোন প্রকার ত্রাণ সরাসরি বিতরণ করা যাবে না বলে আবারও নির্দেশনা দিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো.আলী হোসেন। সকল প্রকার ত্রাণ জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখায় জমা করতে হবে এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষে নিয়ম মাফিক ত্রাণ বিতরণ করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন কথা জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো.আলী হোসেন।

আমাদের উখিয়া প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী থেকে থাইংখালী, উলুবনিয়া, হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, হ্নীলা, মৌলভী বাজার, লেদা, দমদমিয়া সহ উখিয়াটেকনাফের প্রায় ৪০ কিলোমিটার সড়কজুড়ে চলছে বিচ্ছিন্ন ত্রাণ তৎপরতা। মানবতার সহায়তায় রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে চলছে ব্যাপক বিশৃংখলা। দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের ব্যানারে নানা স্থান থেকে ট্রাক, পিকআপ, জিপ, কাভার্ড ভ্যান সহ বিভিন্ন যানবাহন করে প্রচুর সংখ্যক লোক রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে আসছে। গাড়ি দেখলেই রাস্তার ধারের রোহিঙ্গারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এতেই দেখা দিচ্ছে বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য। এমনিতে এ সড়কের দু’পাশে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অস্থায়ীভাবে বস্তি করে অবস্থান নিয়েছে। তার ওপর বিভিন্ন ভিআইপি, ভিভিআইপি, ত্রাণ বিতরণকারী, উৎসুক লোকজনের চাপে স্থানীয়দের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। যানবাহনের অত্যধিক চাপে সকাল থেকে রাত অবধি যান ও জনজট লেগেই আছে। ত্রাণ বিতরণে আগ্রহীদের কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে উখিয়া ও টেকনাফ ইউএনওর সমন্বয়ের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করতে বলা হয়েছে। কারণ রাস্তায় যে কেউ ত্রাণ বিতরণ করলে রোহিঙ্গারা সরকারের নির্দিষ্ট স্থানে স্থানান্তরিত না হয়ে ত্রাণের আসায় রাস্তার ধারে বসে থেকেই অহেতুক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করবে।

উখিয়া উপজেলা প্রশাসন কুতুপালং চৌধুরী ফিলিং স্টেশনের সামনে ত্রাণ সমন্বয় কক্ষ খুলেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে উক্ত ত্রাণ কক্ষে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে আগ্রহী ত্রাণ বিতরণ করতে আসা লোকজনের ত্রাণ সামগ্রী নির্দিষ্ট স্থানে জমা রেখে তা আগ্রহীদের উপস্থিতিতে সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণের কথা। কিন্তু এখানেও বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ত্রাণের গাড়ি কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে তা রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে ত্রাণ দিতে আসা লোকজন সড়কের উপর দাঁড়িয়েই ত্রাণ দেয়া শুরু করছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক যানজট ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। নিক্ষেপ করে করে দেয়া হচ্ছে ত্রাণ। হুড়োহুড়িতে চাপা পড়ছে বয়স্ক ও শিশুরা। হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার শিকারও। গাড়ি চাপায় গতকাল সকাল ৭টার দিকে উখিয়ার ঘাট কাস্টমস এলাকায় ৭ বছরের এক রোহিঙ্গা শিশু ও বুধবার বিকেলে বালুখালীতে একজন রোহিঙ্গা পুরুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরো অনেক রোহিঙ্গা নারীশিশু।

বালুখালী গ্রামের জনৈক জাফর উলহ্মাহ, আব্দুর রহিম কুতুপালং গ্রামের সরকারী দলের নেতা নুরুল হক খান, হাসু মিয়া সহ অনেক সচেতন লোক এধরনের বিশৃংখল পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও অসন্তেুাষ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, সরকার ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য দুই হাজার একরের বেশী জমি বরাদ্দ দিলেও স্বার্থান্বেষী একটি মহল রোহিঙ্গাদের রাস্তার পাশ থেকে নির্ধারিত স্থানে যেতে দিচ্ছে না। এসব মহল রোহিঙ্গাদের ইন্ধন দিচ্ছে নির্ধারিত স্থানে গেলে কোন ধরনের ত্রাণ পাওয়া যাবে না। বরং রাস্তায় থাকলে একের পর এক ত্রাণ মিলবে। ওই মহলটি ত্রাণের মধ্যে দেয়া নগদ টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আগের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসীরা এদের সাথে জড়িত বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা দেখিয়ে বিভিন্ন দেশী বিদেশী সহ নানা সংস্থা থেকে তারা ত্রাণের অর্থ এনে হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। চিহ্নিত এ মহলটিকে দমানো গেলেই রাস্তার ধারে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট স্থানে স্থানান্তর সহ ত্রাণ বিতরণ কাজে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হবে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের নামে যাতে কেউ কোন ধরনের ফায়দা হাসিল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য সংশিহ্মষ্টদের নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু গত তিনদিনও তার নির্দেশ বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে উখিয়ার ইউএনও মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা ও রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট স্থানে স্থানান্তরে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এদিকে আমাদের টেকনাফ প্রতিনিধি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী জানিয়েছেন, গতকাল বিকেলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক মো.আলী হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। এসব সহায়তার ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে যারা পাচ্ছে তারা শুধু পাচ্ছেই, আর যারা পাচ্ছে না তারা কিছুই পাচ্ছে না। একই সঙ্গে হামাগুড়ি, টানাটানি করে ত্রাণ নিতে গিয়ে অনেক মানুষ আহত হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষে বিশেষ ত্রাণ শাখা চালু করা হয়েছে। সকল প্রকার ত্রাণ ওই শাখা জমা রেখে সঠিকভাবে নির্ধারিত কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে বিতরণ করা হবে।

জেলা প্রশাসক জানান, ইতিমধ্যে এ শাখায় বিপুল পরিমাণ ত্রাণ বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন জমা দিয়েছে। এসব ত্রাণ পর্যায়ক্রমে বিতরণও করা হচ্ছে। মানবিক সংকট বিবেচনায় রেখে রোহিঙ্গাদের মাঝে সঠিকভাবে ত্রাণ বণ্টনের কাজ করছে জেলা প্রশাসন। অনিবন্ধিত সকল রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরির কাজ পুরোদমে চলছে উল্লেখ্য করে জেলা প্রশাসক বলেন, তালিকা তৈরি শেষ হলে অবশ্যই ত্রাণ বিতরণে নিয়ম চলে আসবে। বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যকর টয়লেট স্থাপনের কাজও করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. ইকবাল হোসেন জানান, ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে আহত হওয়ার যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে নিহতও হতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ত্রাণ বিতরণে নিয়ম চালু করা হয়েছে। এসময় জেলা প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

 

পাঠকের মতামত: