ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সৈকতে শেষ হলো রাখাইনদের মন রাঙানো বর্ষা উৎসব

সুনীল বড়ুয়া :
একপাশে উপচে পড়ছে সাগরের উত্তাল ঢেউ, অন্য পাশে সবুজ ঝাউবন। যেন অসাধারণ সুন্দরের হাতছানি। আর এই সুন্দরের মাঝেই চলছিল তরুন-তরুনীসহ আবাল বৃদ্ধ-বনিতার আনন্দায়োজন। নাচে-গানে নানা আনন্দ আয়োজনে সমুদ্র সৈকতের ঝাউ বাগানও যেন আনন্দে দুলছে। রোদ কিংবা বৃষ্টি কোনটাই মানছেন না তারা। বরং বৃষ্টি আরো বাড়িয়ে দেয় তাদের আনন্দের মাত্রা।
বলছিলাম,কক্সবাজারে রাখাইনদের মনরাঙানো বর্ষা উৎসবের কথা। গতকাল শুক্রবার (৭ জুলাই) উৎসবের শেষ দিনে এমনই আনন্দ অবাহন বয়ে গেল কক্সবাজার হোটেল শৈবাল সংলগ্ন সৈকতের ঝাউবাগানে। গত ১৯ মে এউৎসব শুরু হয়। সেই থেকে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সৈকতের শৈবাল পয়েন্টে চলে এ উৎসব। গতকাল শুক্রবার ছিল উৎসবের শেষ দিন।
তবে বর্ষা উৎসবের শেষ দিনে গতকাল আবারও প্রাণ হারালো ক্যলাচিং রাখাইন (৫০) নামের এক ব্যক্তি। উৎসব চলাকালে আকষ্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। যে কারণে শেষদিনের উৎসবে আনন্দে কিছুটা ভাটার টান পড়ে।
জানা গেছে, প্রতি বছর বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান তিনমাসব্যাপী আষাঢ়ী পূর্ণিমার আগে (আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত) আড়াই থেকে তিনমাস সৈকতে এ উৎসব পালন করে থাকে রাখাইন সম্প্রদায়। এটি তাদের কোনো সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসব নয়, শুধুমাত্র সবাই মিলে মিশে বৃষ্টি এবং সাগরের জলে সিক্ত হয়ে মহা আনন্দে মেতে ওঠার জন্যই এ উৎসব।
সৈকতের ঝাউবাগানে গোল করে বসে মজার আড্ডায় মেতেছিল রাখাইন তরুণ-তরুণী টিংটিং উ, ছেন ছেন উ, সুইনেয়াইন, এছেন নু, মংলায়াইন, মংখিনছেন ও ছো অং। তাদের মতে, এ উৎসবের সাথে ধর্মীয় উৎসবের কোন সম্পৃক্ততা নেই। সকল দ্বিধা-দ্বন্ধ,সংঘাত হানাহানি ভুলে সবাই মিলে নেচে গেয়ে আনন্দ উল্লাস করে সারাদিন আনন্দে মেতে থাকার জন্যই মূলত এ আয়োজন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী টিংটিং উ বলেন,এ উৎসবে এলেই একান্তই নিজের মতো কিছুটা সময় কাটানো যায়। অনেক পুরনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়। তাই প্রতি বছর এখানে আসার লোভ সামলাতে পারিনা।
উৎসবে এসে কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নে রাখাইন যুবক কেংগ্রী রাখাইনের জবাব,সবাই মিলে-মিশে বৃষ্টি এবং সাগরের জলে সিক্ত হয়ে আনন্দে মেতে ওঠার জন্যই মূলত এখানে আসা। অনেকেই এটিকে বরষা কালীন পিকনিকও বলছে। আমি বলব,এ উৎসবের মধ্যদিয়ে বরষাকে বরণ করা।
শেষ দিনে বন্ধুদের সাথে উৎসবে যোগ দেন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইপসার কর্মকর্তা রজত বড়–য়া রিকু। তিনি বলেন,এখানে না আসলে বুঝতে পারতামনা,আসলেই এ উৎসব কতটা রঙ্গিন,কতটা আনন্দ মুখর। সত্যিই মুগ্ধ হবার মতো। তিনি বলেন, এ উৎসব রাখাইন সম্প্রদায়ের হলেও উৎসবের রঙ কিন্তু সার্বজনীন।
বর্ষা উৎসবের শেষ আনন্দ সমুদ্র ¯œান। সারাদিন ঝাউবাগানে নেচে গেয়ে মন রাঙ্গিয়ে দিনের শেষ লগ্নে সমুদ্র ¯œান শেষে বুকভরা প্রশান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা।
রাখাইন নেত্রী মাটিন টিন জানান, ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে এ উৎসবের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র মজা করার জন্য শতাব্দীকাল ধরে রাখাইন সম্প্রদায় এ উৎসব পালন করে আসছে। প্রথম দিকে হিমছড়ির জঙ্গলে উৎসব পালন করা হতো এবং শুধু কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায় এ উৎসব পালন করতো। রাখাইন তরুণ-তরুনীরা নানা রকমের খাবার দাবারসহ চলে যেতো সেখানে। গত তিন দশক ধরে সমুদ্র আর প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে পেতে সৈকতের ঝাউবাগানে পালন করা হচ্ছে মন রাঙ্গানো এ বর্ষা উৎসব। কিন্তু এখন শুধুমাত্র কক্সবাজারের রাখাইনদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। জেলার গন্ডি পেরিয়ে বান্দরবান,রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি থেকেও লোকজন এ উৎসবে যোগ দেন।

পাঠকের মতামত: