ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সামাজিক বনায়নে পেকুয়ায় পুকুরচুরি

02নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :::

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন কক্সবাজারের পেকুয়ায় সামাজিক বনায়নের গাছ নিলামে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৮০ হেক্টর বনে প্রায় ৫৭ শতাংশ গাছ থাকলেও ২০ থেকে ২২ শতাংশ গাছ দেখিয়ে নামমাত্র টাকায় নিলাম দেওয়া হয়। তা ছাড়া নিলামপ্রাপ্তরা আকাশমণি গাছের সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মাদার ট্রিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছও দেদার কেটে নিচ্ছে। আর এসব অনিয়মের মধ্য দিয়ে সামাজিক বনায়নের অধীন ২০০৬ সালে উপকারভোগী নির্বাচিত হয়ে এক হেক্টর করে বরাদ্দ পাওয়া পরিবারগুলোর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে।

উপকারভোগীদের অভিযোগ, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গাছ কম দেখিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা। পরে নামমাত্র এক কোটি ৩৭ লাখ টাকায় এসব লট নিলাম দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এসব বাগানের লট নিলাম দিলে সরকার অন্তত পাঁচ কোটি টাকা রাজস্ব পেত। পাশাপাশি উপকারভোগীরাও চুক্তি অনুযায়ী আর্থিকভাবে লাভবান হতো। কিন্তু বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গাছ কম দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে তিনজন নিলামগ্রহীতা এসব লট বাগিয়ে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে উপকারভোগী ৮০টি পরিবার আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে এ তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন বারবাকিয়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা উত্তম কুমার পাল। তিনি বলেন, ‘একটি কুচক্রী মহল মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তা ছাড়া এসব লট নিলাম দেওয়ার আগে উপকারভোগীদের উপস্থিতিতে বন বিভাগের কর্মকর্তারা প্রত্যেক গাছে নাম্বারিংও করেন। এতে লুকোচুরি বা পুকুরচুরির কোনো অবকাশ নেই। বাগানে যে পরিমাণ গাছ অবশিষ্ট ছিল সে অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে সর্বোচ্চ দরদাতাদের লট নিলাম দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সামাজিক বনায়নের আকাশমণি ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মাদার ট্রি, সেগুনসহ অন্য কোনো গাছ নিলামগ্রহীতারা কেটে নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। এর পরও যদি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কোনো গাছ কাটা পড়ে, তাহলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অধীন পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া রেঞ্জের টৈটং বন বিটের আওতায় বিগত ২০০৬ সালে সামাজিক বনায়নের ৮০ জন উপকারভোগী নির্বাচন করে প্রত্যেককে এক হেক্টর করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব প্লটে রোপণ করা হয় আকাশমণি গাছ। চুক্তি অনুযায়ী ১০ বছর পর প্লটের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। এরপর চলতি বছরের শুরুর দিকে ৮০ হেক্টর সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে বিক্রির জন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ। এরপর বন বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ৮০ হেক্টর বনায়নের গাছ এক কোটি ৩৭ লাখ টাকায় নিলামপ্রাপ্ত হন তিন ব্যক্তি। তাঁরা হলেন মেসার্স রহমান ট্রেডার্সের মালিক ও একই সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী সমিতির সভাপতি টৈটংয়ের আবদুর রহমান টিপু ও কাটা পাহাড়ের নবী হোছাইন। এ ছাড়া বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং এলাকার শামশুল আলম। নিলামপ্রাপ্তরা গত ১৮ মে পর্যন্ত বনায়নের প্রায় অর্ধেক গাছ কেটে নিয়েছেন। পরে এসব গাছ লট আকারে এবিসি মহাসড়কের টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষিণ পাশে ও নিকটস্থ এলাকায় মজুদ করেছেন। এরপর বন বিভাগ থেকে টিপি নিয়ে বিভিন্ন এলাকার কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে।

সাধারণ উপকারভোগীদের অভিযোগ, বন বিভাগের স্থানীয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে উপকারভোগী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান টিপুসহ কয়েকজন এসব প্লট নিলাম নেওয়ার আগে গাছ পরিমাপের সময় অনিয়মের আশ্রয় নেন। এ কারণে নিলামকৃত বনায়নের গাছ অনুমানের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। এতে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। পরে নামমাত্র টাকায় তিন ব্যক্তিকে এসব লট নিলাম পাইয়ে দেওয়ায় সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি উপকারভোগীরাও তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন উপকারভোগী বলেন, সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান টিপু, সহসভাপতি মৌলানা আহমদ হোছাইন, সদস্য জে এড এম মোসলেম উদ্দিন, জয়নাল আবেদীনসহ বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা গাছের পরিমাণ নির্ধারণ করার সময় অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। বিষয়টি এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তাঁরা আরো বলেন, সামাজিক বনায়নের আকাশমণি গাছের পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মাদার ট্রি, সেগুনসহ অন্য প্রজাতির যেসব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, তা নির্দিষ্ট স্থানে মজুদ করা হচ্ছে না। এসব গাছ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পেকুয়া ও পাশের বাঁশখালী উপজেলার বিভিন্ন সমিলে।

তবে উপকারভোগী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান টিপু এসব বিষয় মানতে নারাজ। তিনি দাবি করেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের সামাজিক বনায়নের লট নিলাম সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সামাজিক বনায়নের লট হিসেবে শুধু আকাশমণি গাছ নিলাম দেওয়া হয়েছে। সেখানে যদি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কোনো গাছ কাটা পড়ে, তাহলে সরেজমিন তদন্ত করে নিলামগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের কোনো যোগসাজশ পেলে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: