ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সেন্টমার্টিনের বিকল্প নাই, আমরা সবাই বাচঁতে চাই

তৈয়ব উল্লাহ :::

ভাঙনের কবলে পড়ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ! বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভেঙে যাচ্ছে দ্বীপ, কিছু মানুষের প্রভাবে ভেঙে পড়ছে সমাজ, আর পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশে ভাঙতে হচ্ছে হোটেল! আতঙ্কে ভেঙে যাচ্ছে আমাদের হৃদয়।
পর্ব-১
বেশ কদিন ধরে পত্রিকা, অনলাইন নিউজ, ফেসবুক স্ট্যাটাস, মন্তব্য, ম্যাসেজ ও মোবাইল কথোপকথন প্রায় সবকিছুতেই সেন্টমার্টিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, আন্দোলন, প্রতিবাদ, পাল্টা প্রতিবাদ, দেশপ্রেমী, দেশদ্রোহী, বিদেশী ষড়যন্ত্র, দ্বীপ ধ্বংসকারী, দ্বীপ রক্ষাকারী, পরিবেশের দালাল, ঢাকাইয়ার দালাল ইত্যাদি নানান জনের নানান কথা! কারটা শুনি কারটা বাদদি সেটাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাওয়া অবস্থা! আসল সমস্যা নিয়ে কেউ কথা বলছে না! শুধু নিজেরা নিজেদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। সমস্যা সমাধানের কথাও কেউ বলছেনা। পত্রিকাও মূল সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করছেনা
শুধু নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ আর অস্থায়ী সমাধান নিয়ে কথা বলছে। পরিবেশ অধিদফতরও সমস্যার গুড়া ঠিক রেখে আগা ছাটায় করে সমস্যা সমাধান করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু তা কখনো টেকসই বলা যাবে না। সমস্যার স্থানী সমাধান করতে হলে, আগে জানতে হবে কি কি কারণে দ্বীপের এই করুণ পরিণতি? আর তা জানলে সমাধান করাও সহজ হবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে নিজেদের তর্কবিতর্ক নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। এই কদিনে যা দেখলাম, তাতে মনে হল শুধু নিজেদের মধ্যে ভুলবুঝাবুঝি হয়েছে মাত্র। কারণ প্রত্যক নিজ নিজ অবস্থানে সঠিক ছিল। কারণ ব্যাখ্যা করছি
১) বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ হিসেবে দেশের সম্পদ, সারাদেশের মানুষেরও সম্পদ, তাই এটি নিয়ে কথা বলার অধিকার সবার আছে। কেউ চাইবে না এমন একটা সম্পদ বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাক।
২) এইদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ হিসেবে, এটির সাংবাদিক ও প্রতিবেদকদেরও একটা দায়িত্ব আছে। দেশের যেকোনো সমস্যার মত এই দ্বীপের নানান সমস্যা ও সমাধান নিয়ে তাঁরা অবশ্যই সংবাদ করবে। কোন অবৈধ বা অনৈতিক অথবা দ্বীপ ধ্বংসী কোন কর্মকাণ্ড হলে, তা প্রতিবেদনের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষকে জানিয়ে দেওয়া তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব। শর্ত এই যে সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত হতে হবে।
৩) সবাই নিজ সম্পদ রক্ষার্থে সম্ভবপর সব চেষ্টা করবে সেটাই সাভাবিক। আর সেটা তার অধিকারও বটে।
৪) সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার বাসস্থান, রাষ্ট্র সেটা দিতে ব্যর্থ হলে ব্যক্তি উদ্যোগে বাস্থানের ব্যবস্থা করা ও রক্ষানাবেক্ষন করা কোন অপরাধ হতে পারে না। তবে সেটা অন্যের ক্ষতি করেও হতে পারে না।
৫) পাথর, বালি উত্তোলন ও ভারি স্থাপনা নির্মাণ আইনগত অবৈধ, অবশ্যই অবৈধ। আইন হাতে নেওয়ার অধিকার কারো নাই। সাংবিধানিকভাবে আইন সকলের জন্য সমান। তাহলে সরকারের জন্য?? সরকার তো নিজেয় আইন মানছে না। হাসপাতাল ও আবহাওয়া কেন্দ্রে প্রচুর বালি ভরাট করছে। আর মেরিন পার্ক, আবহাওয়া কেন্দ্র, ডাকবাংলো, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স, কোষ্টগার্ড ষ্টেশন, নেভি ফরওয়ার্ড ব্যাচ, ওয়াবদা, লাইট হাউস কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ও জেটি ঘাটের মত ভারি স্থাপনা নির্মাণ করে পরিবেশ আইন অমান্য করছে। তাহলে আমাদের বেলা কেন এত কড়াকড়ি?
৬) পাথরের বাধ দেওয়া যাবে না, সিসি ব্লক দেওয়া যাবে না, বালির বাধও দেওয়া যাবে না।আর সরকারও বেড়িবাঁধ দিচ্ছে না, তাহলে দ্বীপের ভবিষ্যৎ?
৭) কারো বিরুদ্ধে অবৈধ লেনদেনের অপবাদ দিলে বা ভিত্তিহীন অভিযোগ তোললে অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ পরিবেশন করছে মনে হলে, আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। তার প্রতিবাদ করার অধিকার অস্বীকার করা বা অগ্রাহ্য করা অথবা অন্য প্রসঙ্গ টেনে অনুচিত বাড়াবাড়ি করে মূল বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার অধিকার কারো নাই।
৮) জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজ এলাকা রক্ষা করা ও জনসাধারণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাক্ষা করা অবশ্যই তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।সে যেই হউক তা করবেই। আর তা পালন করতে কারো বাধা দেওয়াও অনুচিত।
৯) এলাকার ক্ষতি হয় বা জনগণ চাইনা অথবা উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয় এমন কাজ নাকরাই উচিৎ। আর জনগণ মন্দ বলুক তা প্রতিনিধিদের প্রত্যাশা হতে পারে না।
১০) এই দ্বীপ যেহেতু সবার সেহেতু দ্বীপ রক্ষায় সকলকে ঐকমত হওয়া প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতক ব্যক্তি, ছাত্র সমাজ, বিজ্ঞ জন ও সর্বস্তরের জনসাধারণকে সাথে নিয়ে এইসব কাজ (দ্বীপ রক্ষা) করা উচিৎ।
পরের পর্বঃ কি কি কারণে দ্বীপের এই বেহাল দশা!

যারা সেন্টমার্টিন নিয়ে ভাবে তাঁদের প্রতি অনুরোধ এই পর্ব মনোযোগ দিয়ে পড়তে।
পর্ব-২
এইবার কি কি কারণে দ্বীপের এই বেহাল দশা তা আলোচনা করিঃ
১) সেন্টমার্টিন ভাঙনের প্রধান ও অন্যতম কারণ হচ্ছে নাফ নদীর গতি পরিবর্তন। সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই বা কারো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! নাফ নদী নাব্যতা হারিয়ে, গতি পরিবর্তন হয়ে পূর্বদিকে সরে গেছে । আর পূরাতন মোহনা ও গতিপথে সেন্টমার্টিনের চেয়ে প্রায় ১২/১৩ গুণ বড় ডুবো চর বা দ্বীপসৃষ্টি হয়েছে।(গুগল আর্থ ম্যাপ ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে) ফলে সামুদ্রিক স্রোত বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। যে কারণে দ্বীপের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তরাংশ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে বা ভেঙে যাচ্ছে। বিষয়টি কারো কাছে হাস্যকর মনে হলেও অতিবাস্তব। গবেষণা করতে হবে না, ভুগোলের স্রোত পড়ে, সেন্টমার্টিনের আগের জোয়ার, ভাটা ও স্রোত হিসেব করলেই ফলাফল যে কেউ পেয়ে যাবে। আগে জোয়ারের সময় মহাসাগরীয় স্রোত বা সামুদ্রিক স্রোত দ্বীপের দক্ষিণ দিক থেকে পশ্চিম পাশ হয়ে, উত্তর দিকে যেত, আবার কিছু অংশ চাঁদের মত বাকা হয়ে বদর মোকাম হয়ে নাফ নদীতে প্রবেশ করত। আর ভাটির সময় নাফ নদীর স্রোত দ্বীপের পূর্বদিক হয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যেত,ফলে দ্বীপে তেমন স্রোত আঘাত করত না। এখন দ্বীপের উত্তর পূর্বদিকে চর বা নতুন দ্বীপ সৃষ্টি হওয়ায় মহাসাগরীয় স্রোত বা সমুদ্র স্রোত আগের মত বদর মোকাম হয়ে প্রবেশ করতে পাড়ছেনা, ফলে স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা আগের চেয়েও বেশি হয়, এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এই বিষয়টি যে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। নালা বা প্রবাহমান জলধারে অথবা স্রোত আছে বা সৃষ্টি করে এমন পানিতে ডুবন্ত কিছু দ্বারা হাল্কা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এর পাশাপাশি উজানে পানি ফুলে উঠবে বা পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ও পানি উত্তাল হবে।
২) ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বীপ ভাঙনের জন্য অন্যতম দায়ী। মহাসেন,কোমেন ও রোয়ানোর মত ঘুর্ণিঝড় ঘনঘন আগাত করায়, দ্বীপের রক্ষাকবচ খ্যাত, অদুরবর্তি প্রাকৃতিক পাথরের মজবুত দ্বীপগুলো নড়েবড়ে হয়ে পড়ে, ফলে স্রোত প্রতিরোধের সক্ষমতা হারিয়ে পেলে।
৩) বৈশ্যিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারনে মেরু অঞ্চল বা হিমবাহের বরফ গলে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। যা নিয়ে আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশংকা করেন। তাঁদের ধারণা মতে ২০৫০ সাল নাগাদ ২/৩ অংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যাবে। যার প্রভাব ইতিমধ্যে সেন্টমার্টিনে পড়ছে।
৪) ভারী স্থাপনা নির্মাণ দ্বীপের প্রাকৃতিক কাঠামো নষ্ট করে দিয়েছে। যদিও এটি একটি ডুবো পাহাড়ের চুড়া, যার সৃষ্টি টারশিয়ারি যুগে। মানে হিমালয় ও মিয়ানমারের পাহাড় সৃষ্টির সময় সৃষ্ট। কিন্তু যে অংশ(সেন্টমার্টিন দ্বীপ) এখন ভাসমান আছে, সেটা পাহাড়ের মূল চুড়া নয়, কারণ এর কোন প্রমাণ তেমন দৃশ্যমান নায়। সামান্য যা দৃশ্যমান তাকে মূল চুড়া বলা যাই না। আসল চুড়া আরো নিছে, সামান্য ডুবো ডুবো অস্থায়। মূলচুড়ার শীলা ভেঙে পাথর হয়, আর পাথরে প্রবাল জন্মায়, আর ডুবো পাহাড়ের চুড়ায় পাথর ও প্রবালের সাথে নাফ নদী হতে আসা পলি মাটি জমে দ্বীপের সৃষ্টি। আর দ্বীপের মাটি এখনো পুরু হয়নি বা পূর্ণতা পায়নি। ফলে ভারী স্থাপনা নির্মাণ দ্বীপকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আর ধ্বংস হতে চলেছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।
৫) পাথর ও বালি উত্তোলন দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিছে। ফলে দ্বীপ ভয়ংকর হুমকির মুখে। চরের পাশাপাশি যে কোন সময় লোকালয়েও পানি ডুকে যেথে পারে! কেননা দ্বীপের চারপাশে থাকা উঁচু বালি টিলাগুলো এখন সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে লোকালয় আর সাগরের মাঝে কোন প্রতিবন্ধকতা নাই। এছাড়া পাথর স্থানান্তর করার কারনে দ্বীপ অনেক নিচু হয়ে গেছে ও কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ অংশে জমি দখল করার সময় প্রচুর পাথর স্থানান্তরিত হয়েছে (কেউ রাস্তা করছে আবার কেউ জমির ভাউন্ডারী করছে, আবার কেউ ভেঙে কংক্রিট বানিয়েছে) । ফল স্বরূপ ভুমি তলিয়ে যাচ্ছে আর বৃষ্টির পানির সাথে মাটি সাগরে নেমে যাচ্ছে।
৬) বন উজাড় ও বৃক্ষনিধনও দ্বীপ ভাংনের একটি কারণ। দ্বীপের চারপাশের কেয়াবন ও দক্ষিণের গভীর বন উজাড় করে জমি বৃদ্ধি করার কারণে দুর্যোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। ফলে সামান্য বাতাস যেমন দ্বীপকে আতঙ্কিত করে তোলছে তেমন সামান্য জোয়ারেও পানি লোকালয়ে ডুকছে।
৭) প্রবাল উত্তোলন ও ঝিনুক আহরণও দ্বীপ ভাঙনে দায়ী। প্রবাল চুনাপাথর সৃষ্টি করে, ফলে পাথরের সংখ্যা বাড়ে, এতে দ্বীপের গঠন আরো সুসংহত করে। কিন্তু প্রবাল আহরনের ফলে এইসব কিছুই হচ্ছে না। বরং প্রাকৃতিক ভূমি কাঠামো নষ্ট হচ্ছে। আর মৃত ঝিনুক আহরণে সৈকতের বালি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কড়ি আহরণ করার সময় পাথরের প্রাকৃতিক ভাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফলে পাথরের স্রোত প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
৮) নিয়মিত খাল খনন না করা ও জলাবদ্ধতাও দ্বীপ ভাঙনের একটি মুখ্য কারণ। বর্ষায় বৃষ্টির পানি ও জোয়ারের পানি খাল খননের অভাবে পানি আটকা পড়ে, এতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে দ্বীপের মধ্য ভাগের বালুগুলো পানির কারনে বুদবুদ সৃষ্টি হয়। এই কারনে সবার অগুচরে দ্বীপের তলা দিয়ে বালি বের হয় যায়, আর পানির চাপে অনেক মাটি সাগরে তলদেশেচলে গেছে। ফলে দ্বীপ অনেকাংশ তলিয়ে গেছে এবং ধেবে গেছে। আর জোয়ারের সময় নতুন করে ভাঙন হচ্ছে। উদাহরণসরুপ নতুন পুকুর খনন করলে দেখা যায় পানির সাথে মাটি তরল আকারে চলে আসে।
পরের পর্বঃ কিছু প্রকল্পের সমালোচনা।

ভাঙনের কবলে পড়ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ! বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভেঙে যাচ্ছে দ্বীপ, কিছু মানুষের প্রভাবে ভেঙে পড়ছে সমাজ, আর পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশে ভাঙতে হচ্ছে হোটেল! আতঙ্কে ভেঙে যাচ্ছে আমাদের হৃদয়।
পর্ব-৩
দ্বীপের স্বার্থে কিছু পরিকল্পনা বা কাজের যুক্তিযুক্ত সমালোচনা কিরছি। সাথে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করলাম।
১) কারো কারো ধারণা শুধু ভারী স্থাপনা ভেঙে দ্বীপের উপর চাপ কমালে ভাঙন রোধ হবে! এটি ১০০% সঠিক নয়। ভাঙ্গনরোধে শুধু একমুখী কাজে প্রতিকার সম্ভব না। উদাহরণস্বরূপ ধলঘাটা, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, শাহপরীরদ্বীপ ও ছেড়াদ্বীপ ভাঙনে ভারী নির্মাণ দায়ী নয়। এমনকি নাবিকবিদ্যায় বাংলাদেশের দক্ষিণের সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে উল্যেখিত ‘বদর মোকাম’ এখন শুধুই নাম! তার কোন অস্তিত্ব নাই! আর এটি যে ভারী কোন স্থাপনা বা নির্মাণের কারণে তলিয়ে গেছে বা বিলীন হয়ে গেছে এমন কোন তথ্য নাই।।
২) অনেকে মনে করছে জিওট্যাক দিলে হয়তু সাময়িক রেহাই পাওয়া যাবে! না কাজের কাজ কিছুই হবে না। বরং অপচয় হবে আর হয়তু ক্ষতি আরো বাড়বে! বালি দূরের কিংবা কাছের যাইহোক! উদাহরণস্বরূপ অনেক আগে থেকে প্রিন্স হেভেন, প্রাসাদ প্যারাডাইস ও পান্না রিসোর্ট জিওট্যাক বসিয়েছিল। কিন্তু কোন কাজে আসেনি বরং ঐসব স্থাপনার সামনে আরো বেশী ক্ষয় হয়ে ভাঙন হয়েছিলো!
৩) আবার কেউ কেউ বলে সৈকতে শুধু গাছ রোপন করলেই ভাঙন রোদ করা সম্ভব! তাও বোকামি ছাড়া কিছুই না! উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশ ফরেষ্টের সেন্টমার্টিন শাখার উদ্যোগে ঝাউগাছ রোপণ ও নেকমসহ অনেক পরিবেশবাদী সংঘটন বা সংস্থার উদ্যোগে কেয়াগাছ, নিশিন্দা ও লতা রোপণ করেও কোন কাজে আসেনি! যতবার রোপণ করেছে আর ততোবার তলিয়ে গেছে। শুধু যেখানে জোয়ারের পানি আসেনি বা আসেনা সেখানেই এই বৃক্ষরোপণের অস্থিত্ব আছে! পক্ষান্তরে যেখানে বেড়িবাঁধ বা প্রাকৃতিক বাধ আছে সেখানেই এই কর্মসূচী ১০০% সফল হয়েছে। যেমন বাদাম বনিয়ার ম্যানগ্রোভ বন।
৪) আর যারা বলে ভারীস্থাপনা ভেঙে, পর্যটন বন্ধ বা সীমিত করে ও বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে দ্বীপ রক্ষা করা যায়। এটাও একমাত্র সমাধান হতে পারে না! উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ তালপট্টি! এটি বিলিন হওয়ার পেছনে পর্যটন বা পর্যটক, ভারী স্থাপনা ও বৃক্ষনিধন কিছুই দায়ী নয়!
[এই সমালোচনা থেকে বুঝা যায়, শুধু দুয়েকটা কর্মপরিকল্পনা দিয়ে সেন্টমার্টিন রক্ষা সম্ভব না! এইজন্য প্রয়োজন বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা। যা নানাবিধ, পর্যটন ও পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই হওয়া আবশ্যক। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা, দাবি বা পরামর্শ পরবর্তী বা শেষ পর্বে তোলে ধরবো।]
পরবর্তী পর্ব বা শেষ পর্বঃ পর্যটন মুখী, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সমাধান।

সেন্টমার্টিনের বিকল্প নাই, আমরা সবাই বাছতে চাই!
যদি হারে প্রবালদ্বীপ, ঠকবে তবে বাংলাদেশ।

পর্ব-৪(শেষ পর্ব)
উত্তরণের উপায়:

সেন্টমার্টিনের ভাঙ্গনরোধ, স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও পুনঃ গঠন করতে হলে বহুমুখী ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু দুয়েক পরিকল্পনা নিলেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। বরং সম্পদের অপচয় হবে মাত্র। টেকসই ও বহুমুখী পরিকল্পনা জন্য কিছু প্রস্তাব সকলের কাছে তোলে ধরছি। যদি বহুমুখী সকল পদক্ষেপ সমন্বয় সম্পাদন করা যায়, তাহলে সেন্টমার্টিন হবে আরো সুসংঘটিত, পরিবেশবান্ধব, টেকসই, মজবুত ও কাঠামোগত উন্নত। ফলে আর্থিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নতি সাধিত হবে।
১) মাষ্টার প্লান করে, নাফ নদীর মোহনায় সৃষ্ট ডুবো চর বা দ্বীপ খনন করে সরিয়ে দিতে হবে, ফলে নাফ নদীর গতি আগের অবস্থানে ফিরে যাবে আর স্রোতের প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। এছাড়া ঐ বালি দিয়ে সেন্টমার্টিনের চারপাশে বিলীন হয়ে যাওয়া বালির স্তুপ (ডেইল) পুনঃগঠন করতে হবে। এতে দ্বীপ তার পুরনো অবস্থায় ফিরে যাবে।
২) আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় পাওয়া ক্ষতিপূরণবাবদ টাকা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে সেন্টমার্টিনের জন্য আলাদা বরাদ্ধ দিতে হবে। যা দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়।
৩) টেকসই বেড়িবাঁধ দিতে হবে। যা করতে হবে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি (যতটুকু সম্ভাব) এড়িয়ে।
৪) বেড়িবাঁধের পাশাপাশি ব্যাপক বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। যার দ্বারা পরিবেশের উন্নয়ন, বাঁধের রক্ষা, দুর্যোগ মোকাবেলা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।
৫) শুধু হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র ও স্কুল বাদে সব বহুতল ভবন ও ভারী স্থাপনা গুড়িয়ে দিয়ে, সব ধ্বংসস্তূপ দ্বীপের বাহিরে সরিয়ে দ্বীপকে ভার মুক্ত করতে হবে।
৬) প্রতিবছর বর্ষার আগে গভীর করে খাল খনন করতে হবে। যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়।
৭) দ্বীপের চারপাশের প্রবালের প্রজনন ও পুনঃ গঠন করতে হবে এবং এইগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
৮) পাথর, প্রবাল, ঝিনুক, কড়ি আহরণ, বালি উত্তোলন, বৃক্ষনিধন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। এবং এ কাজে নিয়োজিত মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তারা অভাবের তাড়নায়, জীবিকার সন্ধানে আবার আত্মঘাতি এই কাজে জড়িয়ে না পড়ে।
৯) দ্বীপবাসীকে(তরুণ, ছাত্র, কর্মক্ষম ব্যক্তি ও নারীদের) শিক্ষা, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, কম্পিউটার, ভ্রমণ গাইড, ট্যুরিজম, পরিবেশ ও  বিভিন্ন প্রশিক্ষণ মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। যাতে তাঁরা  বিভিন্ন পেশা ও বিকল্প পেশায় নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে। এতে অতিপর্যটন নির্ভরশীলতা কমবে। আর অনৈতিক, অবৈধ ও দ্বীপের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে।
১০) স্থানীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিক কুটির ও পর্যটন শিল্প বিকাশে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে দ্রুত অনগ্রসর জনগোষ্ঠির আর্থসামাজিক প্রসার ঘটে।
১১) দ্বীপের জন্য খুব দ্রুত অবকাঠামো নির্মাণ নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যাতে আর কেউ অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ করে দ্বীপকে হুমকিতে পেলতে না পারে।
১২) দ্বীপের জনগোষ্ঠীর নাগরিক ও সামাজিক অধিকার সমুন্নত রেখে, পরিবেশবান্ধব ও যুগোপযোগী পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
১৩) পর্যটন শিল্পকে যান্ত্রিকতার পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ইকো ট্যুরিজম সিস্টেমে রূপান্তরিত করতে হবে।
১৪) সকল পরিকল্পনা ও কাজ যেন পরিবেশবান্ধ ও পর্যটনবান্ধ বা পর্যটন মুখী হয়। পরিবেশবান্ধ করতে গিয়ে পর্যটন বিমুখ কিংবা পর্যটনবান্ধ করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি যেন না হয়। দুটির সমন্বয়ে উন্নয়ন হওয়া প্রয়োজন।
১৫) নীতিমালা বা কর্ম পরিকল্পনা তৈরিতে দ্বীপবাসীর বিশ্বাস, আর্থসামাজিক ও নাগরিক অধিকার যেন ক্ষুন না হয় সেদিকে সতর্কতার সাথে দৃষ্টি রাখতে হবে।
১৬) সেন্টমার্টিনে সরকারী বেসরকারি সকল প্রকল্পে যোগ্যতা ভিত্তিক ৫০% চাকরির কোটা সংরক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তোলতে হবে। এতে অনগ্রসর দ্বীপবাসীর আর্থিক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দ্বীপ ব্যবহারে আন্তরিকতা বাড়বে।
১৭) কোন অবস্থাতে যেন দ্বীপ ও দ্বীপবাসীর ক্ষতি না হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্বীপ ও দ্বীপবাসীর স্বার্থ সমুন্নত রাখতে হবে।
১৮) দুর্যোগ প্রতিরোধের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯) স্থানীয় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
২০) উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

লেখক :
তৈয়ব উল্লাহ, সভাপতি সেন্টমার্টিন স্টুডেন্ট ফোরাম।
তার পেইজবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত।

পাঠকের মতামত: