ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কী হবে দারুল ইহসানের সনদধারীদের?

অনিয়মের শীর্ষে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল ইহসান। সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০০৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেয়া সনদ বাতিলেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সনদধারীরা। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের দায় তাদের নিতে হবে কেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইউজিসির এই সিদ্ধান্তের ফলে দারুল ইহসান থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ও লাইব্রেরি সায়েন্সের ডিপ্লোমা সনদধারীদের আপগ্রেডেট গ্রেড বা চাকরি টিকবে না। তার আগে ২০১৩ সালের পর থেকে দারুল ইহসানের এলএলবি সনদধারীদের বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিতে দেয়া হচ্ছে না। বার কাউন্সিল ওই সময় জানায়, দারুল ইহসানের একেকজনের সনদে একেকজনের স্বাক্ষর থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের। তারা বলেন, একই বছরের সনদ, কিন্তু একেকজনের সনদে একেকজনের স্বাক্ষর। এতে আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সনদ যাচাই করার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। ডিআইএ সূত্রমতে, ২০১১ সালের পর দারুল ইহসানের কোনো সনদ গ্রহণ করা হচ্ছে না। ওই বছরের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত শুধু দারুল ইহসানের সাড়ে ৩ হাজার সনদ বাতিল ও আপগ্রেড পাওয়া গ্রেড বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। ডিআইএ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পরিদর্শন করতে গিয়ে এই সাড়ে তিন হাজার সনদ ধরা পড়েছে। দারুল ইহসানের সনদ নিয়ে চাকরি করছে বা বিএড সনদ দিয়ে গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে এই শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় অর্ধলক্ষাধিক হবে।
ডিআইএ উপ-পরিচালক রাশেদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার সময় দারুল ইহসানের সনদের ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শাখা থেকে সার্টিফিকেট দেয়া হতো। কোর্টে মামলা চলাকালীন থাকায় তাদের ব্যাপারে সরাসরি কোনো সুপারিশ করতে পারিনি। তবে ধানমন্ডি শাখা ছাড়া অন্য কোনো শাখার সনদ গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমরা সুপারিশ করেছি। এখন হাইকোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করায় আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হেলাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, ২০১১ সালের পর থেকে দারুল ইহসানের কোনো সনদ গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তার আগে দারুল ইহসানের সনদ দিয়ে যারা চাকরি নিয়েছেন তাদের ব্যাপারে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, এটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। কিন্তু সনদ বৈধ বা অবৈধের ব্যাপারে কিছু বলেননি বলে আমি জানি। ইউজিসি চেয়ারম্যানের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। রোববার ইউজিসি চেয়ারম্যান তার দপ্তরে মানবজমিনকে বলেন, ২০০৬ সালে ইউজিসি দারুল ইহসানকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল। কোর্ট যেহেতু আমাদের ঘোষণার আলোকে রায় দিয়েছেন, সেহেতু তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অবৈধ বলে গণ্য হবে। এরপরের সনদও অবৈধ। চেয়ারম্যানের এই ঘোষণার পর নতুন করে দুচিন্তায় পড়েছেন কয়েক হাজার সনদধারী। বিশেষ করে ২০০৬ সালের পর বিএড ও লাইব্রেরি সায়েন্সের ডিপ্লোমাধারীরা। জানা গেছে, ২০০৬ সালে দারুল ইহসান কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার পর বিএড ও লাইব্রেরি সায়েন্স ডিগ্রি নেয়ার হিড়িক পড়ে। কারণ, সাধারণ একজন শিক্ষক বিএড ডিগ্রি জমা দেয়ার পর তার ১১তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে যান। তার বেতন বাড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এদিকে গতকাল ২০০৬ সালের পর দারুল ইহসানের সকল সনদ অবৈধ প্রতিবেদন প্রকাশের পর মানবজমিন অফিসে ফোন করে অনেকেই জানতে চান, এখন আমাদের কী হবে। প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের দায় আমরা কেন নেবো?
চাকরি হারানোর আতঙ্ক: ইউজিসি চেয়ারম্যান গত রোববার সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ২০০৬-এর পরে যারা দারুল ইহসানে ভর্তি হয়েছে তাদের সনদ বাতিল গণ্য হবে। এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর গতকাল তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে পাস করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাদের সনদ বৈধ হবে কিনা তা জানার জন্য গতকাল অনেকে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ-খবর নেন। একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, ১০ বছর পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর সনদ অবৈধ ঘোষণা করার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও নেই। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের মাধ্যমে ২৯টি শাখা ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়ে যারা পাস করেছেন তাদের সনদ বাতিল করা হবে কেন? অন্যান্য ক্যাম্পাস ইউজিসি বন্ধ না করায় এর দায়দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের নয়, ইউজিসিকে নিতে হবে।
২০০৮ সালে পাস করে বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. সবুর হোসেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ ঘোষণার পর থেকে অফিসের সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা কটাক্ষ করে কথা বলেন। তিনি বলেন, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ইমেজ সংকটে পড়েছি। তার চেয়ে বড় সংকট চাকরি হারানোর ভয়। যেখানে যাই সেখানেই বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। সিলেটের একটি বেসরকারি কলেজে চাকরি করছেন ফারজানা হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন, একটা ভার্সিটির বিরুদ্ধে রায় দিতে এত দেরি হলে তার দায়ভার কে নেবে? সবাই তো সার্টিফিকেট কেনেননি! যারা কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে তাদের কী অপরাধ?

পাঠকের মতামত: