ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

জেলাব্যাপী ভূমি অফিসে উমেদার রাজত্ব

dorniti_2বিশেষ প্রতিবেদক :::

কক্সবাজার জেলার ভূমি অফিস গুলো অবৈধ উমেদারের দখলে হওয়ায় সেবা নিতে আসা মানুষের মাঝে ভোগান্তি-দুর্ণীর্তি চরম পর্যায়ে। এনিয়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ভুমি অফিসগুলোতে সেবা নিতে মানুষের মধ্যে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দেশের অতিদুর্নীতি প্রবণখাতগুলির মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সাব রেজিস্টারী অফিস, উপজেলা ভুমি অফিস, ইউনিয়ন ভুমি অফিস অন্যতম। ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় ভুমি বিরোধ, ভূমিকর আদায়, নামজারি, জমাখারিজ, জমা একত্রিকরন সেবা দেয়াই ভুমি অফিসের মুলকাজ। তবে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ভুমি অফিসে সেবা নিতে আসা ভূমি মালিকদের জিম্মি করে পরগাছা পোষক উমেদার’রা সেবা প্রত্যাশীদের রক্তচুষকে পরিণত হয়েছে। সেবা প্রদানের নামে সাধারণ সেবা গ্রহীতাদের টুটি চেপে তাদের কাছ থেকে উমেদার’রা হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় ভুমি অফিসের সরকার নিযুক্ত কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তা না হয়েও এরা সরকারী ভুমি অফিসের সমস্ত ইউলিটি ব্যবহার করে সরকারী কর্মকর্তাদের মতো দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে। ভূমি অফিসে সংরক্ষিত ভুমি দলিল-দস্তাবেজের গোপনীয়তা এদের কারণে অরক্ষিত বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভূমি কর্মকর্তা অভিযোগ করেন।
তথাকথিত ইউনিয়ন ভুমিকর্তাদের আসকারায় উমেদার’রা সারাবছরই পোয়াবারো অবস্থায় দিন কাটে। ভূমি প্রশাসনের নিম্নপদস্হ কিছু কর্মচারীও আর্থিক সুবিধা নিয়ে উমেদারদের কাজ করার সুযোগ করে দেন। অনুসন্ধানে প্রকাশ, ইতিপূর্বে ঈদগাঁও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পিয়ন পদে কর্মরত ছৈয়দ নুর অত্র অফিসে কয়েকজন উমেদার নিয়োগ করে। তার মেয়েজামাই শুক্কুর, আত্নীয় বদরু ও অারো কয়েকজন তখন থেকে ঈদগাঁও ভূমি অফিসের সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে আসছে। পরে বিভিন্ন অভিযোগে পিয়ন ছৈয়দ নূরকে রামু ইউনিয়ন ভূৃমি অফিসে বদলী করা হলেও সেখানেও কয়েকজন উমেদার নিয়োগ দেন তিনি। এভাবেই বাড়ছে উমেদার রাজত্ব।  অন্যদিকে অসাধু ও দুর্নীতিবাজ ভুমি কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে দিনের পর দিন উমেদারদের ব্যবহার করে আসছে। তাদের মাধ্যমে ভূমির লেনদেন নিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন ভুমিকর্তাদের দুর্বলতার সুযোগে উমেদাররা ভুমি অফিসের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকে প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছে ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী ইউনিয়ন ভুমি কর্মকর্তা জানান, ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কিছু অবসরভোগী কর্তারা নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় নিকট আত্মীয়দের উমেদার হিসেবে স্থানীয় ভুমি অফিসগুলিতে নিযুক্ত করেন। সে থেকেই জেলার প্রতিটি ভুমি অফিসে উমেদার সংস্কৃতি গড়ে উঠে। তিনি আরও জানান, উমেদার’রা দীর্ঘদিন একই অফিসে কাজ করার সুবাদে এরা নিজেদের শক্তপোক্ত ও সুদুরকৃত শেকড়সহ প্রভাব ও প্রতিপত্তিবলয় সৃষ্টি করে বহাল তবিয়তে কাজ করে যাচ্ছে।
ভুমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত বিভিন্ন পরিপত্র ও ভুমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০, ভুমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪, ভুমি প্রশাসন ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশসহ ভুমি সংক্রান্ত কোন আইনে উমেদার বিষয়ে কোন প্রকার উল্লেখ নাই।
হাসান জাহাঙ্গীর আলম সম্পাদিত
উপ-মহাদেশীয় ভুমি অভিধানে উমেদার সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা কালেকটর অফিসে (জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ) চাকুরীর প্রত্যাশায় বিনা বেতনে কাজ করে তারাই উমেদার। নামে উমেদার হলেও তারা কিন্তু হেলাফেলার পাত্র নয়, ভুমি অফিসগুলিতে দেখা যায় তারাই যেনো অফিসের বস এবং তাদের ছাড়া অফিসের সব কাজ অচল। অফিসের নিয়োগ প্রাপ্ত কেউ না হওয়া সত্ত্বেও ভুমি অফিসে সরকারী ফাইলপত্র ,দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ সম্পাদন করে চলেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর । আর ওই সুযোগে ভুমি অফিসে কর্মের পাশাপাশি চলছে অপকর্ম।
অভিযোগ আছে, ভুমি অফিসে জনবলের অভাবের অজুহাত দেখিয়ে অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্তাব্যক্তিরা ওই সকল বহিরাগতদের অফিসে ঠাঁই দিয়ে তাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। দেখা গেছে, ভুমি অফিসের টেবিলের উপর ফাইলপত্রের স্তুপ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দলিল দস্তাবেজ, পর্চা-খতিয়ান । নিবিষ্ট মনে ফাইলপত্র যাচায়ই বাছাই করছেন একজন লোক। তাকে ঘিরে উদ্বিগ্ন মনে দাঁডিয়ে আছে বেশ কিছু লোক। তারা এসেছেন তাদের ফাইলের অগ্রগতি জানতে। চেয়ার বসা লোকটির কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তার ভাবসাব দেখে মনে হবে তিনিই ওই অফিসের বড় সাহেব তাকে ছাড়া অফিস অচল।
ওই দৃশ্য জেলার ইউনিয়ন ভুমি অফিস, উপজেলা ভুমি অফিস ও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায়ও । ভূমি অফিসের এই আলোচিত চরিত্রটির নাম ‘উমেদার’। অফিসে বসে কাজের বিনিময়ে তাঁরা কোনো বেতন ভাতা পান না।‘উপরি’ নিয়েই তাঁরা সন্তুষ্ট।
ফার্সি উমেদার শব্দের অর্থ ‘সাহায্য প্রত্যাশী ব্যক্তি’। মোঘল আমলে এই উমেদাররা ভূমি অফিসে ‘চাকরিপ্রত্যাশী ব্যক্তি’ হিসেবে কাজ করতেন। একসময়ে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাঁরা চাকরিতে বহাল হতেন। সেই থেকে চলে আসছে এ চর্চা।
এখনো তাঁরা চেয়ার-টেবিল নিয়ে অফিসে ব্যস্ত সময়ে কাটান। ভূমি মালিকদের কাছ থেকে নামজারির ফাইল গ্রহণ করেন। অনেক সময়ে দাখিলা (খাজনার রশিদ) কেটে টাকা জমা নেন। ফাইলপত্র দেখে সব কিছু ঠিকঠাক করে দেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। এমনকি ছুটির দিনেও তাঁদের অফিসে ব্যস্ত সময়ে কাটাতে দেখা যায় । এ ধরনের উমেদারদের উপস্থিতির কথা প্রশাসনের উচ্চমহলও জানে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, উচ্চপর্যায়ে থেকে লোকবল নিয়োগের অনুমতি না পাওয়ার কারণেই ভূমি অফিসে বহিরাগতদের কাজে লাগানো হচ্ছে। এতে মাঠপর্যায়ে ভূমি প্রশাসনে নানা জটিলতা সৃষ্টি হলেও এর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করা হয়।
কক্সবাজার সদরের একজন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সদর উপজেলাসহ জেলার সব ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশেই যুগের পর যুগ চেয়ার-টেবিল নিয়ে উমেদাররা রাজত্ব চালাচ্ছেন। তা ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের রক্ষা করার জন্য উমেদারদের দিয়ে ঘুষ গ্রহণ থেকে শুরু করে অনেক অনৈতিক কাজ করিয়ে থাকেন। একজন কর্মকর্তার অধীনে ছয়-সাতজন উমেদার কাজ করে থাকেন বলে তিনি জানান।
কারণ কোনো অনৈতিক কাজের জন্য উমেদারকে জবাবদিহি করতে হয়না। তাঁরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সরেজমিনে, জেলার এমন অনেক ভূমি অফিস রয়েছে, যেখানে কর্মচারীর চেয়ে উমেদারের সংখ্যা বেশি। তাঁরা সরকারি ছুটির দিনেও অফিস খুলে মক্কেল ধরার কাজ করেন। এভাবে ভূমি অফিসের নিরাপত্তা ও গোপনীয় তা হারাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলি, এসিল্যান্ড অফিস ও জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ভূমি শাখায় কমপক্ষে ৫০০ জন প্রভাশালী উমেদার রয়েছে, যাঁদের একাধিক বাড়ি-গাড়ি আছে। অনেকের প্রতিদিনের আয় ১০/২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
একাধিক উমেদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা যে ভূমি অফিসে কাজ করেন তা সবারই জানা। আইনগতভাবে তাঁরা কর্মচারী না হলেও প্রাচীন রীতি অনুযায়ী ভূমি অফিসের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। তাই তাঁদের দাবি, উমেদারদের স্থায়ী চাকরি না দিলেও অন্তত দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীর (মাস্টাররোল) মর্যাদা দেওয়া হোক। এতে তাঁদের ওপর সরকারের জবাবদিহিতা বাড়বে বলে দাবি করেন প্রবীণ একজন উমেদার। প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহণ থেকে শুরু করে অফিসের নথিপত্র, রেকর্ডপত্রের জালিয়াতি এবং সাধারণ ভূমিমালিকদের কন্ট্যাকমেইল করার সঙ্গে উমেদারদের কারো কারো সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায় ।
জেলার রামু, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, উখিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়ন ভুমি অফিস ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি ভুমি অফিসে ৫ থেকে ৬ জন উমেদার কাজ করছে।
জানা গেছে প্রত্যেক উমেদার সংশ্লিষ্ট অফিসে ৮ থেকে ১০ বছর আবার কেউ কেউ এর চেয়ে বেশী সময় ধরে কাজ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপজেলা ভুমি অফিসের ভুমি সহকারী অভিযোগ করেন, সরকার নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরীর বিধি মেনে কাজ করতে হয়, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু উমেদার’রা সে সকল বিধি বিধানের উর্ধ্বে। অথচ এরা বছরের বছর ধরে একই স্থানে একই অফিসে কোন প্রকার জবাবদিহিতা ছাডাই কাজ করে যাচ্ছে। উমেদারী যেনো এদের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক সময় ওই সকল উমেদার’রা ক্ষেত্রে বিশেষে ভুমিকর্তাদেরও কর্তা বনে যায়। পাছে ভুমিকর্তাদের টাকা কামানোর পাইপ-লাইন বন্ধ হয়ে যায় সে কারণে কর্তারা সময়-সুযোগ বুঝে এদের বেশ সমীহ ও সমঝে চলেন।
একজন সহকারী ভুমি অফিসার দুঃখ করে বললেন, আমরা সরকার নিযুক্ত কর্মকর্তারা একটু ভুল করলে বা পান থেকে চুন খসলেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বা জৈন্তাপুরে বদলী করে চাকরীর স্বাদ মিটিয়ে দেয়। আর উমেদার’রা থাকে রাজার হালে,তাও বছরে পর বছর ।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোন নজরদারী না থাকার কারণে উমেদারদের খপ্পর থেকে পরিত্রাণ পান না ভুমি অফিসের সেবা গ্রহীতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উমেদার জানান, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রধান সহকারী ওমর মিয়া ও অফিস সহকারী মোঃ শরীফ তাদের থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন। উমেদার পোষক হিসাবে পরিচিত রামু ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পিয়ন ছৈয়দ নূরের মাধ্যমে এসব মাসোহারা আদায় করা হয় বলে জানা গেছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, উক্ত ছৈয়দ নূর আবারো ঈদগাঁও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে বদলী হয়ে আসতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এতে মদদ দিচ্ছেন রাজস্ব শাখার উপরোক্ত দুই কর্মকর্তা।

পাঠকের মতামত: