ঢাকা,শনিবার, ৪ মে ২০২৪

চকরিয়া জমজম হাসপাতাল! ভূয়া ল্যাব টেকনিশিয়ানের নামে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
কক্সবাজারের চকরিয়া জমজম হাসপাতালে ল্যাব টেকনোলজিস্ট বিহীন ভুয়া টেকনিশিয়ান দিয়ে দীর্ঘ ১৩ মাস ধরে রোগনির্ণয়ের পরীক্ষা করে প্রতারণা পূর্বক জনগণ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

জমজম হাসপাতাল লিঃ এর ২০২২/২৩ সালের লাইসেন্স নবায়নের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো তথ্যে-রিপোর্ট প্রদান কারী রেডিওলজিস্ট এন্ড ইমেজিং অফিসার হিসেবে দেখানো ডাঃ এইচ এম নওশাদ (বিএমডিসি রেজিষ্ট্রেশন নং-১০০৪০৭), ডিপ্লোমা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হাফিজুল ইসলাম (রেজি নং-২১৪৪০) ও প্যাথলজি টেকনিশিয়ান কেউ হাসপাতালটিতে চাকুরী করেন না।
হাসপাতালের ল্যাব ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আমিনুল ইসলামের নেই কোন অভিজ্ঞতা বা নেই কোন ধরনের ল্যাবে কাজ করার সনদ। এই ভুয়া টেকনিশিয়ান দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে হাসপাতাল কতৃপক্ষ।

অন্য দিকে হাসপাতালের স্টাফ নার্স, ডিপ্লোমা নার্স ও বিএসসি নার্স হিসেবে কর্মরত দেখানো হয়েছে  ৩৬ জন নার্স।
তাদের মধ্যে ২৭ জন জমজম হাসপাতালে কখনো চাকুরী করেননি। অনেকেই হাসপাতালটি কোথায় সেটি চেনেন না বলে জানান।
জমজম হাসপাতালের কাগজে পত্রে দেখানো টেকনোলজিস্ট হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমি ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। হাসপাতাল কতৃপক্ষ আমাকে সাত দিনের বেতন দেয়নি। আমি তাদের কাছে ওই টাকা এখনো পাওনা আছি। ২২/২৩ সালে আমাকে কর্মরত দেখানো হাস্যকর ও প্রতারণার সামিল।

হাসপাতালের ল্যাব ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি বিগত ২৩ বছর ধরে এই হাসপাতালে কর্মরত আছেন। ল্যাবের কাজের কোন সার্টিফিকেট বা সনদ না থাকলেও তার কাছে ঢাকায় কর্মরত একজন এমবিবিএস ডাক্তারের সহকারী হিসেবে ৫/৬ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা সনদ রয়েছে বলে দাবী করেন।

তিনি আরও জানান, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখে ল্যাব টেকনিশিয়ান হাফিজুল ইসলাম চলে যাওয়ার পর থেকে এ বছরের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত অন্য কোন টেকনিশিয়ান/ টেকনোলজিস্ট নাথাকায় হাসপাতাল কতৃপক্ষের নির্দেশে তিনি যাবতীয় পরীক্ষা নীরিক্ষার রিপোর্টে ল্যাব ইনচার্জ হিসেবে স্বাক্ষর করতেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো তথ্যে ল্যাব ইনচার্জ হিসেবে আমিনুল ইসলামের নাম কোথাও নেই।

হাসপাতালের স্থায়ী নিয়োগ দেখানো ডিপ্লোমা নার্স আঁখি সুশীল বলেন, আমি ২০২০ ও ২০২১ সালে চাকুরির আবেদন করে দুই দফায় হাসপাতালটিতে বায়োডাটা জমা দিয়েছিলাম। কতৃপক্ষ নিয়োগ না দেওয়ায় জমজমে কখনো চাকুরী করা হয়নি। বর্তমানে ইউনিসেফের অধিনে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন বলেও জানান তিনি।

ইসরাত জাহান সুরভী নামের এক ডিপ্লোমা নার্সকে তার মোবাইলে ফোন করা হলে গোলাম সরওয়ার নামের এক ব্যক্তি ফোন রিসিভ করে তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ বলে জানান। জমজম হাসপাতালটি কোন জেলায় অবস্থিত তিনি জানেন না ও চেনেন না উল্লেখ করে তার নার্সিং রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ব্যবহার করে প্রতারণা মুলক প্রতিষ্ঠান জমজম হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানান তিনি।

ইয়াসমিন আক্তার নামক অপর নার্সের জায়গায় দেখা যায় টাঙ্গাইলের এমডি সনেটের মোবাইল নাম্বার। সেও কখনো জমজম হাসপাতালে চাকুরী করেননি এবং বর্তমানে তিনি কক্সবাজারের জিকেতে চাকুরী করেন বলে জানান।

এভাবে দিনের পর দিন প্রতারণা করা চকরিয়া জমজম হাসপাতাল ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম কবিরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম কবিরের ব্যক্তিগত মোবাইল নাং-০১৭১৫৬৭৪৮৬৮ এ যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে, ওনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

হাসপাতালটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা ডাঃ একেএম ফজলুল হক বলেন, আমাদের তো অনারারি পোস্ট, এটির ব্যবস্থাপনায় আমাদের তেমন দায়িত্ব থাকেনা। হাসপাতালের পুরো কার্যক্রম দেখা শোনা করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ গোলাম কবির।

দীর্ঘদিন ল্যাব টেকনোলজিস্ট না থাকার বিষয়টি তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন না। জানতে পারার পরপরই গত ২৮ নভেম্বর নতুন টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানান।

দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনায় হাসপাতালের কার্যক্রমের বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় মতো ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডাঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, জমজম হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন ফাইলে বেশকিছু অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় ২০২২/২৩ সালের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। ল্যাব টেকনোলজিস্ট বিহীন দীর্ঘদিন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য যে, গত ১৬ নভেম্বর জমজম হাসপাতাল থেকে মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির (৪০) নামের একজন ভুয়া চিকিৎসকে আটকের পর ভ্রাম্যমান আদালত ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়। এর প্রেক্ষিতে হাসপাতালটির কার্যক্রম সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে আজ মঙ্গলবার ১৩ডিসেম্বর/২২ থেকে ফের জমজম হাসপাতাল খোলে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।

পাঠকের মতামত: