ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

লবণআমদানির খবরে আতঙ্কে চাষিরা

কক্সবাজার প্রতিনিধি :: প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো থাকায় দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদন এলাকা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী অঞ্চলের ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ চাষে নেমেছেন চাষীরা। এরইমধ্যে গত দুই নভেম্বর মৌসুমের প্রথম দফায় মাঠ থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিক থেকে প্রতিটি মোকামে পুরোদমে লবণ উৎপাদন নিশ্চিত হবে এমনটাই জানিয়েছেন বিসিক কক্সবাজার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

মৌসুমের শুরু থেকে আবহাওয়া লবণ উৎপাদনের অনুকূলে থাকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে লবণ চাষ। এবার মৌসুমের শুরুতেই কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকুলীয় অঞ্চল, পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী, বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলার জমিতে একমাস আগে লবণ চাষ শুরু হয়েছে।

চাষিদের আশা, আবহাওয়ার পরিবেশ এ ধরণের থাকলে দেশে এবার চাহিদার বিপরীতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হবে। সিন্ডিকেট চক্র কর্তৃক বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কারণে পরপর বেশ কয়েক মৌসুম চাষিরা বিপুল পরিমাণ লবণ উৎপাদন করেও লোকসান গুণতে হয়েছে। এবার সবকিছু লবণ উৎপাদন সহায়ক থাকায় চাষিদের মুখে ফুটেছে হাসি।

তবে বরাবরের মতো এবারও শিল্প মন্ত্রাণালয় এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের কাছে চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম হবে এইধরণের আগাম মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন কতিপয় সিন্ডিকেট চক্র। তাঁরা মুলত দেশে লবণের ঘাটতি দেখিয়ে বিদেশ সোডিয়াম লবণ আমদানির জন্য সব রকমের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাষিদের দাবি সরকার যেন সিন্ডিকেট চাপের মুখে প্রভাবিত না হয়। দেশে যেভাবে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে তাতে কোনো ঘাটতিই থাকবে না।

কক্সবাজার বিসিক সুত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর নভেম্বরের শুরুতে চাষিরা লবণ উৎপাদনে মাঠে নামেন। তবে এবছর একমাস আগে অক্টোবর থেকে মাঠে নেমেছেন চাষীরা। এবার ৩৭ হাজার চাষি লবণ চাষে নিয়োজিত হয়েছেন। মাঠে উৎপাদন কাজে জড়িত থাকে আরো ৭৫ হাজার শ্রমজীবি মানুষ। পরিবহন লোড-আনলোড এবং মিলপর্যায়ে প্যাকেটিং ও বাজারজাত সেক্টর মিলিয়ে দেশীয় লবণ শিল্পে মোট ৫ লাখ মানুষ প্রতিবছর নিয়োজিত থাকেন।

এবছর মোট ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ চাষের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তদমধ্যে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা (আংশিক এলাকা) থেকে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিসিক।

কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য মহেশখালীতে জমি অধিগ্রহণ করায় চলতি মওসুমে ১৫-২০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে না। এর সাথে সংশি¬ষ্ট ২৫ হাজার প্রান্তিক চাষিও বেকার হয়ে পড়েছেন। কক্সবাজার জেলা ছাড়া বাঁশখালী উপজেলার কিছু এলাকাতে লবণ উৎপাদন হয়। এ ছাড়া দেশের আর কোথাও লবণ উৎপাদিত হয় না।

জানতে চাইলে কক্সবাজরের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, চলতি মওসুমে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে চাষ শুরু করা হয়েছে। গতবছর জমির পরিমাণ ৬৩ হাজার ২৯১ একর থাকলেও এবছর চাষের পরিধি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এবার আবহাওয়ার পরিবেশ বেশ ভালো।
তিনি বলেন, প্রতিবছর নভেম্বর মাসে চাষ শুরু হলেও এবার বিভিন্ন মোকামে একমাস আগে থেকে লবণ চাষে নেমেছেন চাষীরা। এরইমধ্যে কুতুবদিয়া উপজেলার মাঠ থেকে মৌসুমের প্রথমদফার লবণ উঠেছে। আশাকরি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুরো অঞ্চলে লবণ উৎপাদন পুরোদমে শুরু হবে, তাতে লবণের কোনধরণের ঘাটতি থাকবেনা।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি ও চকরিয়া উপজেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, লবণ আমদানি চক্র সুকৌশলে সোডিয়াম সালফেট (মিল-কারখানায় ব্যবহৃত লবণ) নাম দিয়ে দেশে অহরহ নিয়ে আসছে সোডিয়াম কোরাইড তথা খাদ্যলবণ। এসব লবণ তারা চীন থেকে আমদানি করে সরাসরি বাজারজাত করছে। আমরা বিষয়টি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

তিনি বলেন, আমদানি নির্ভর কিছু লবণ মিল মালিক সবসময়ই লবণ আমদানির জন্য অনুমতি পেয়ে থাকেন। তারা চান দেশীয় লবণ শিল্প চিরতরে বন্ধ হয়ে যাক। বিপরীতে সুফল হিসেবে তাঁরা দেশের টাকা লুটেপুটে খাক।

এবছরও বিদেশ থেকে লবণ আমদানির পায়ঁতারা চলছে অভিযোগ করে বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.শহিদুল ইসলাম বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবছর প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো থাকায় একমাস আগে থেকে লবণ চাষে নেমেছে চাষীরা। এরইমধ্যে লবণ উৎপাদনও শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কতিপয় সিন্ডিকেটকে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির জন্য অনুমতি দিচ্ছে সরকার এইধরণের খবরে চাষীদের মাঝে উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা দাবি জানাই সরকারের কাছে, দেশীয় লবণ শিল্পকে বাঁচান. এই শিল্পে জড়িত পাঁচ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার পথ সচল রাখুন।

তার মতে, দেশের লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে বিদেশ থেকে আমদানির জন্য প্রতিবছর সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। এতে কমপক্ষে আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হবে। আশাকরি সরকার বিদেশ থেকে লবণ আমদানির মতো আত্মঘাতি সিদ্বান্ত থেকে সরে আসবেন জনগণের স্বার্থে, দেশীয় লবণ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে।

পাঠকের মতামত: