ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

মাল্টিপারপাসের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ

লোভনীয় অফারে প্রতারণা, অবশেষে ধরা

অনলাইন ডেস্ক :: হাজারো গরিব মানুষের কয়েকশ’ কোটি টাকা ‘মেরে দেয়া’র অভিযোগে অভিযুক্ত বহুল আলোচিত মজিবুর রহমানকে আবারো গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একজন রিকশা চালক হিসেবে বছর কয়েক আগেও জীবন ধারণ করা মজিবুর রহমান মাল্টিপারপাস এবং উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নামে বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার গ্রাহকের শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বড় প্রতারকে পরিণত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায়ও কয়েক বছর জমিয়ে প্রতারণা করে চট্টগ্রামে নিত্য নতুন কৌশল শুরু করেন মজিবুর। ইতোপূর্বেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। গতকাল আবারো প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তারের পর তাকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন।

বিভিন্ন মামলার অভিযোগ- পুলিশ এবং স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, মজিবুর রহমানের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানার নেওয়াপাড়ায়। তার বাবার নাম আমজাদ আলী। নগরীর ইপিজেড এলাকায় দীর্ঘদিন রিকশা চালাতেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে তিনি কয়েকজন রিকশা চালককে নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন। কিছুদিন পর ওই সমিতিকেই তিনি ‘রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ এবং ‘রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ নামের কোম্পানি গঠন করেন। এই দুইটি কোম্পানি থেকে তিনি বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা শুরু করেন। ইপিজেডের শত শত গার্মেন্টস শ্রমিক, এলাকার ক্ষুদে ব্যবসায়ী, হকার, বাসা বাড়ির কাজের বুয়াসহ হাজার হাজার মানুষ থেকে নানাভাবে তিনি আমানত নিতে থাকেন। গ্রাহকদের লাভও দিতে থাকেন। বেশ কৌশলে তিনি আস্থা অর্জন করেন মানুষের।

পরবর্তীতে বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করেন তিনি। দুই বছরে ডাবল হওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় অফার দেন। আর এসব অফারে বিভ্রান্ত হয়ে সাধারণ মানুষ নিজেদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করতে থাকেন। এভাবে শত কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেন তিনি। পুলিশ জানিয়েছে যে, শুধু চট্টগ্রামেই নয়, ঢাকায়ও প্রতারণার ফাঁদ পাতেন মজিবুর এবং তার সহযোগীরা। বিলাসবহুল অফিস স্থাপন করে মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে থাকেন। এই সময় বিমানে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াতসহ আলীশান জীবনযাপন শুরু করেন মজিবুর এবং তার সতীর্থরা।

ঢাকা এবং চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি অফিস খুলে তাতে হাজার খানেক কর্মীও নিয়োগ দেয়া হয়। এই কর্মীরাই সাধারণ মানুষের কাজ থেকে আমানত সংগ্রহের কাজটি সম্পন্ন করেন। আমানত সংগ্রহের পর এক থেকে দেড় বছর চুক্তি অনুযায়ী লাভ দেয়া হতো। এরপরই আজ নয় কাল করে শুরু হতো ঘোরানো এবং প্রতারণা। কিছুদিন পর অফিস বন্ধ করে কোম্পানি গা ঢাকা দেয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা থেকে এভাবে এই কোম্পানি অফিস গুটিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। কোম্পানির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় ছোট স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। বড় স্ত্রী থাকেন বন্দরটিলা এলাকায় আলাদা বাসায়। এই দুজনের বাইরে তার আর কোনো সংসার আছে কিনা তাও পুলিশ খতিয়ে দেখছে।

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, মজিবুর আপাদমস্তক একজন ভয়ংকর প্রতারক। নানা কৌশলে তিনি মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছেন। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে পথে বসিয়েছেন। এনামুল নামের এক ব্যক্তি ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই সময় ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৮ কোটি ৪২ লাখ টাকাসহ রাসেল হাওলাদার, মুসা হাওলাদার ও গোলাম ফয়সাল নামে তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছিল। জাকির হোসেন হাওলাদার ও এজাজুল খান নামের অপর দুইজনের নামও মজিবুর রহমানের সতীর্থ হিসেবে বিভিন্ন মামলার আসামি বলে পুলিশ জানায়।

পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই চক্রটি বহু মানুষের কাছ থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মানুষের টাকাগুলো স্রেফ মেরে দেয়া ছাড়া তারা আর কোনো কাজ করেনি। সাধারণ বহু মানুষকেই একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে চক্রটি। এদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
মজিবুর রহমানকে বুধবার গভীর রাতে গ্রেপ্তার করেছে ইপিজেড থানা পুলিশ। তার গ্রেপ্তারের খবরে শত শত প্রতারিত মানুষ ইপিজেড এলাকার চৌধুরী মার্কেটস্থ অফিস প্রাঙ্গণে এসে ভিড় জমান। চৌধুরী মার্কেট দ্বিতীয় তলায় দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি অফিস চালিয়ে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গতকাল কার্যালয় প্রাঙ্গণে সবিতা রানী শীল নামের এক নারী তার পুরো জীবনের সঞ্চিত ৬৩ হাজার টাকা রশিদ নং- ১২৭৪ ও ১৮৯১৫ নং রশিদে ২৮ হাজার টাকাসহ মোট ৯১ হাজার টাকা আমানত হিসেবে জমা রাখার কথা জানিয়ে বলেন, আমার আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু দফায় দফায় ধর্ণা দিয়েও টাকা ফেরত পাইনি। তার মতো কয়েক হাজার নারী পুরুষের বিপুল পরিমাণ অর্থ এই প্রতারক চক্র হাতিয়ে দিয়েছে বলেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি তার জীবনের সঞ্চয় ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবিরুল ইসলাম গতকাল বলেন, আমরা গোপন খবরের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বহুমুখী প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত মজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছি। সে বহু মানুষের বহু টাকা আত্মসাৎ করেছে। আমরা তাকে আদালতে উপস্থাপন করেছি। আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। তাকে রিমান্ডে আনা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

প্রতারিত গ্রাহকেরা বলেছেন, মজিবুর রহমান বড় প্রতারক। তার বিপুল সম্পত্তি রয়েছে। মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে মজিবুর বিভিন্ন জায়গায় সম্পদ গড়েছে। তার সম্পদগুলো বিক্রি করে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

পাঠকের মতামত: