ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

“সাত ভাই চম্পা” বিলুপ্তের পথে গানের পাখি

_17অনলাইন ডেস্ক :::

আমাদের গ্রামগঞ্জের অতি চেনা গানের পাখি সাত ভাই চম্পা । আকর্ষণীয় এই পাখিটি শুধু বর্ণালী পালক আর সুদীর্ঘ লেজের জন্যই নয়, বরং সুরেলা কণ্ঠের জন্যও সবার নজর কাড়ে। কিন্তু অবাধ বৃক্ষ ও বনাঞ্চল নিধন এবং প্রাকৃতিক বৈরিতা, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা আর আবাদী জমিতে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগের কারণে বিলুপ্তের খাতায় নাম লেখানোর উপক্রম হয়েছে পাখিটির। এখন খুব একটা চোখে পড়ে না এ পাখি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই প্রজাতিটি অপরিচিত হতে বসেছে।
বাংলাদেশের পাখি বিষয়ক একাধিক জার্নাল ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত মারফত জানা যায়, অঞ্চলভেদে এর অন্য নাম ছাতারে, ছাতারিয়া বা সাত ভাই। ইংরেজিতে সেভেন সিস্টার্স, হিন্দিতে সাত বহিন, ঘোঙ্গগাই, কাচবাচিয়া, ফিঙ্গিয়া ময়না নামে পরিচিত। ইংরেজী নাম ঔঁহমষব ইধননষবৎ ও বৈজ্ঞানিক নাম ঞঁৎফড়রফবং ংঃৎরধঃধ। খবরড়ঃযৎরপযরফধব (লিওথ্রিকিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত ঞঁৎফড়রফবং (টুর্ডোইডিস) গণের অন্তর্গত এক প্রজাতির মাঝারি গায়ক পাখি সাত ভাই চম্পা।
সাত ভাই চম্পারা সাধারনত এক সঙ্গে ৬/৭ জনে দল বেঁধে ঘুড়ে বেড়ায় আর তাই হয়তো নাম হয়েছে সাত ভাই চম্পা। কথিত আছে এদের দলে ছয় ভাই ও এক বোন, যার নাম চম্পা। এর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত মিলিয়ে প্রায় ২৫ সে.মি বা ১০ ইঞ্চির মতো লম্বা, দেখতে অনেকটা শালিকের মতোই; তবে আকারে একটু বড়। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম দেখতে, তফাৎ করা যায় না। সাধারনত ওজন ১৫-২৩ গ্রাম হয়ে থাকে। পিঠের সব পালক মলিন ধুলোমাটি বা ফিকে খয়েরি কিংবা ছাই রংয়ে প্রলেপ। তবে কিছু কিছু পালকের রং গাঢ় হয়ে থাকে। লেজ চওড়া ও বেশ লম্বাটে, প্রায় ডানার মাপের সমান। চোখে হলুদ বৃত্তের মাঝখানে কালো ফোঁটা। ঠোঁট ও পা হলদেটে বর্নের।
ঢিলেঢালা পালকগুলো, ডানা ছোট এবং প্রায় লেজের সমান বলে ভালো উড়তে পারে না। অল্প দূরে এ গাছ থেকে ওগাছে পরপর দলের সবাই একে একে উড়ে যাওয়াটা এদের রুটিন মাফিক অভ্যাস। আশেপাশে লোকজন বা প্রাণী না থাকলে তবেই মাটিতে নেমে আসে তারা। তখন প্রত্যেকটি পাখির সজাগ দৃষ্টি থাকে পাতার নিচের কোথায় পোকা লুকিয়ে আছে, তা খুঁেজে বের করে আহারাদী সম্পূর্ণ করা। যে কোন সময় হঠাৎ চেঁচামেচি, কিচিকিচি, ক্যাচম্যাচ করে ওঠে দলবদ্ধ পাখিগুলো। এরা সাধারণত ফলফলাদি, শুঁয়োপোকা, গোবরেপোকা ও অন্যান্য ছোট কীট-পতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে ছোট ফল-ফলাদি, খেজুরের রসের প্রতিও প্রচন্ড আসক্তি রয়েছে ।
সবচেয়ে আশ্চর্য্য বিষয় হচ্ছে, এই পাখির বাসায় পাপিয়া, চাতক (বা কোলা বুলবুল), গোলা কোকিল (বা ঝুটিদার পাপিয়া, ইংরেজিতে পায়েড ক্রেস্টেড কুক্কু) ডিম পেড়ে যায়। পাপিয়া ও চাতককে দেখলে একদম ক্ষেপে যায়, তখন পাপিয়া পালিয়ে গেলেও পরে সুযোগ বুঝে অল্পক্ষণের মধ্যে ডিম পেড়ে যায়, ছাতারে বুঝতেই পারে না।
সাত ভাই চম্পা সাধারণত বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্থানে দেখা যায়। এ পাখি ভীরু স্বভাবের, হঠাৎ ভয় পেলে এ ঝোপ থেকে ও ঝোপে লাফ দিয়ে পালায় এবং দেখতে দেখতে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুম হেরফের রয়েছে। জলাশয়ের কাছাকাছি ঘাসবন কিংবা লতাগুল্মের ভেতর ডিম্বাকৃতির বাসা বানায়। পাটকেলে সাদা রংয়ের ডিম, সংখ্যায় ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। জুন-নভেম্বর মাসে ঘাসের গোড়ায় কিংবা ভূমির খুব কাছে অন্য উদ্ভিদের ঘাস দিয়ে মোচাকার কিংবা বাটির মতো বাসা বানায়।
প্রজননকালীন জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। রাত্র যাপনও করে দলবদ্ধভাবে। সবচেয়ে মজাদার বিষয়টি হচ্ছে এদের দলের কেউ ডিম-বাচ্চা ফুটালে শাবকদের যতœআত্তি দলের সবাই মিলেই করে। অনেক সময় দলের সবাই মিলে অন্যের ডিমে তা দিতে দেখা যায়। এরা মূলত জলাশয় এলাকায় বিচরণ করে। বিশেষ করে শনবন, নলখাগড়ার বনের ভেতর এদের বিচরন ও আবাসস্থল গড়তে দেখা যায়। এদের গানের গলা বেশ মিষ্টি। মানিকগঞ্জে একসময় খুব দেখা মিলতো পাখিগুলোর। কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা খুবই কম, যে সাধারনত দেখা মেলাই ভাড়। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সম্প্রতি আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে।

পাঠকের মতামত: