নীতিশ বড়ুয়া, রামু ::
কক্সবাজারের রামু ও উখিয়া উপজেলার বৌদ্ধ বিহার এবং পল্লীতে চালানো নারকীয় হামলার বিচার আট বছরেও শেষ হয়নি। সাক্ষীর অভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া থমকে থাকলেও রামু-উখিয়ার বৌদ্ধদের মাঝে ফিরেছে সম্প্রীতি। পোড়া মন্দিরে তৈরী হয়েছে নান্দনিক স্থাপনা। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাশৈলীতে পূণ্যার্থীদের পাশাপাশি বেড়েছে পর্যটক আকর্ষণ। ক্ষতিগ্রস্থরা পেয়েছেন নতুন ঘর। এখনও নিরাপত্তায় সতর্ক রয়েছে প্রশাসন। তবে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে রয়েছে অসন্তোষ। অপরাধীদের বেশিরভাগ আইনের আওতায় না আসায় তাদের শংকাও কাটছেনা।
রামু সহিংসতার আট বছর আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে বুদ্ধমূর্তি, বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ উগ্র-সাম্প্রদায়িক হামলার সেই বিভীষিকাময় দিন স্মরণে বিগত বছরের ন্যায় এ বছরও স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ। দিনব্যাপী এ স্মরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন, রামু পানের ছড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সুচারিতা মহাথের। প্রধান ধর্মদেশক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পুণ্যাচার ভিক্ষু সংসদের সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রামের পটিয়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ড. সংঘপ্রিয় মহাথের। এ উপলক্ষে লাল চিং-মৈত্রী বিহার কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে ভোরে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্ট পরিষ্কার দানসহ মহাসংঘদান, দুপুরে শান্তিপুর্ণ মানববন্ধন, অতিথি ভোজন, বিকালে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সন্ধ্যায় বিশ^শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ স্থানীয় বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা অংশ নেবেন বলে জানান, ২৯ সেপ্টেম্বর স্মরণ অনুষ্ঠানে আহ্বায়ক বিপুল বড়ুয়া আব্বু, সদস্য সচিব বিপ্লব বড়ুয়া ও অর্থ সম্পাদক রুবেল বড়ুয়া।
২০১২ সালের ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর রামু ও উখিয়া-টেকনাফে বৌদ্ধপল্লীতে চালানো নারকীয় হামলার ১৮ মামলার একটি বিচারও শেষ হয়নি। ন্যাক্কারজনক এ ঘটনায় দায়ীরা কেউ শাস্তি পায়নি এখনও। ঘটনারপর বিভিন্ন মামলায় ৯৯৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় আটকরা সবাই এখন জামিনে। অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। ঘটনার পরপরই ক্ষতিগ্রস্থ বৌদ্ধ বিহার ও ঘরবাড়ি পুণনির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। দীর্ঘ আট বছরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেকটা ফিরে এসেছে বলে জানান রামুর বৌদ্ধরা।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পি. পি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, বৌদ্ধ মন্দির ও বসতিতে হামলার ঘটনায় সর্বমোট ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়। তৎমধ্যে বাদীর সম্মতিতে ১টি মামলা প্রত্যাহার হয়। অন্য ১৮টি মামলা আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সাক্ষীর সহযোগীতায় বিচারকার্য তরান্বিত হবে। তিনি জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার সবরকম পদক্ষেপ নিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, পুলিশ যদি মামলার স্বাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন, স্বাক্ষীরা যদি যথাযথ সাক্ষ্যদান করেন তাহলেই প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে এবং ঘটনার সত্য উদঘাটন হবে।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সাধারণ সম্পাদক রাজু বড়ুয়া জানান, রামু সহিংসতার আট বছর পার করছি আমরা। ঘটনার এ আট বছরে রামুর পরিস্থিতি অনেকটা ভালো। তবে এ ধরণের ঘটনা যাতে আর কোথাও না ঘটে, এ জন্য সকলকে আরো সর্তক থাকতে হবে। তিনি বৌদ্ধদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ সরকার ও রামুবাসির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তরুন বড়ুয়া জানান, রামুতে ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রদায় জানে না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এদের অনেকেরই নাম পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। রামু সহিংসতার মতো আর কোন ঘটনা যাতে বাংলাদেশে আর না ঘটে সেটার একটা দৃষ্টান্ত রচিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন এ বৌদ্ধ নেতা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর ১২ বৌদ্ধ বিহার, ৩০টি বসতঘর, পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে ৭টি বৌদ্ধ বিহার, ১১টি বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পুড়ে যায় এসব মন্দিরে থাকা হাজার বছরের পুরাতাত্ত্বিক সব নিদর্শন। লুটপাট ও ভাংচুর করা হয় আরো ৬টি বৌদ্ধ বিহার, অর্ধশত বৌদ্ধ বসতঘরে। এ ঘটনার পর দায়ের করা হয় ১৯টি মামলা। এর মধ্যে রামুর আটটি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে রামু থানার জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দু’পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করা হয়।
রামু সহিংসতার ঘটনা দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে আঘাত হেনেছিল তা অনেকটা দূর হয়েছে। তবে সম্পূণরূপে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া সময় সাপেক্ষ বলে জানান কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু। তিনি বলেন, রামু সহিংসতার আট বছরে ফিরে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। রামুর বৌদ্ধরা পেয়েছে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার। কিন্তু রামুর ঘটনার পর যেই মামলাগুলো হয়েছে সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সংশয়।
জানা গেছে, বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনায় দায়ের ১৯ মামলার এজাহারে নাম-ঠিকানা উল্লেখিত আসামি ছিল ৩৭৫ জন। রামু থানার আট মামলার এজাহারে মোট আসামি সাত হাজার ৮৭৫। এর মধ্যে ১১১ জনের নাম-ঠিকানা থাকলেও পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছিল মাত্র ৭৪ জনকে। আর সন্দেহভাজনদের মধ্যে আটক করেছিল ১৩২ জনকে। উখিয়া থানার সাত মামলায় পাঁচ হাজার ৬২৪ আসামি থাকলেও গ্রেফতার ছিল ১১৬ জন। টেকনাফ থানার দুটি মামলায় ৬৫৩ আসামির মধ্যে গ্রেফতার ছিল ৬৩ জন। কক্সবাজার সদর মডেল থানায় দুই মামলায় এক হাজার ৩০ আসামি থাকলেও গ্রেফতার ছিল ৯৮ জন। গত আট বছরে ধাপে ধাপে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে সবাই।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি জড়িতদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে সুপারিশ করে। কিন্তু ঘটনার পরিকল্পনাকারী গডফাদারদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে আটক করে এসব মামলা দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। আবার অনেক সাক্ষীর নাম-ঠিকানাও লেখা হয় ভুলভাবে। তাই আটক সবাই পেয়ে গেছে জামিন। দায়ীরা রয়েছে এখনও অধরা। সচেতন মহলের মতে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী, গডফাদার বা নেতৃত্বদাতাদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেই বেরিয়ে আসবে ঘটনার আসল রহস্য। এ ঘটনায় জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রত্যাশা ছিল প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। এ ঘটনার বিপরীতে যেসব মামলা হয়েছে তার সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন নিরাপরাধ ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন এবং প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হয় এমন প্রত্যাশা সকলের।
পাঠকের মতামত: